০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ জিলহজ ১৪৪৫
`

এসএসসিতে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি : জিপিএ-এর বদলে বর্ণ

- ছবি : সংগৃহীত

পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়নে জিপিএ পদ্ধতি উঠিয়ে সাত স্কেলে মূল্যায়ন হবে। সেই স্কেলগুলোর বাংলা নামও নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নাম নয় ইংরেজি বর্ণ দিয়ে তা নির্ধারণ করা হবে।

তবে সেই বর্ণগুলো কী হবে তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি বলে জানান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো: মশিউজ্জামান।

তিনি বলেন, এটা ইংরেজি বর্ণ দিয়ে নির্ধারণ করা হলেও বর্তমানে প্রচলিত নম্বরের ভিত্তিতে যে গ্রেডিং সিস্টেম আছে সেরকম হবে না।

নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে যা থাকছে
মূল্যায়নের জন্য ৬৫ শতাংশ ওয়েটেজ হবে লিখিত পরীক্ষার ভিত্তিতে এবং ৩৫ ভাগ ওয়েটেজ হবে কার্যক্রমভিত্তিক, যেটা সরাসরি যার যার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ওপর থাকবে।

কোনো শিক্ষার্থী যদি ৭০ শতাংশ কর্মদিবস ক্লাসে উপস্থিত না থাকে তাহলে সে পাবলিক পরীক্ষা দিতে পারবে না। আর আগের মতো টেস্ট পরীক্ষা থাকবে না। এসএসসি পরীক্ষা হবে শুধু দশম শ্রেণীর সিলেবাসের ভিত্তিতে।

কোনো শিক্ষার্থী যদি এসএসসি পরীক্ষায় এক বা দুই বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হয় তাহলে শর্তসাপেক্ষে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ পাবে। তবে তাকে পরবর্তী দু’বছরের মধ্যে এসএসসি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বিষয়ে পাস করতে হবে। আর তিন বা তার বেশি বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হলে একাদশ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়া যাবে না।

লিখিত ও কার্যক্রমভিত্তিক এই দু’ভাগে মূল্যায়ন হলেও প্রশ্নের ধরন এখনকার মতো থাকছে না। কার্যক্রমভিত্তিক, যেমন অ্যাসাইনমেন্ট করা, উপস্থাপন, অনুসন্ধান, প্রদর্শন, সমস্যার সমাধান করা, পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয়ের সাথে মিল রেখে হবে লিখিত অংশের মূল্যায়ন। শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীনেই এখনকার মতো কেন্দ্রভিত্তিতে হবে পরীক্ষা বা মূল্যায়ন।

একেকটি বিষয়ে পাঁচ ঘণ্টা পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও এটা আরো একটু নমনীয় করার জন্য সোমবারের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে এক স্কুল দিবসে মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবির) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো: মশিউজ্জামান বলেন, “আমরা তো আগেই মূল্যায়নের জন্য সাত মাত্রার স্কেল নির্ধারণ করেছিলাম। এর সর্বনিম্ন ছিল ‘প্রারম্ভিক’। আর সর্বোচ্চ ‘অনন্য’। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে যে যদি কেউ বলে আমার বাচ্চা ‘অর্জনমুখী’ পেয়েছে, তাহলে অনেকে বুঝবে না। তারা বলবে এটা কী? নম্বর কত? কারণ এখানে তো কোনো নম্বর থাকবে না। তাই এটাকে আরেকটু কম্যুনিকেটিভ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগে যেমন এ+ ছিল সর্বোচ্চ নম্বর, এখন সেটাকে ‘এ’ দিয়ে বোঝালে মানুষ বুঝতে পারবে যে এটা সর্বোচ্চ নম্বর। আগে আমরা স্কেলের সাতটি ঘর পূরণ করে দেয়ার কথা বলেছিলাম। যার যত ঘর পূরণ হবে সে অনুযায়ী তার ফল হবে। এখন সাত ঘর পূরণ হলে ধরেন ‘এ’ হবে। সর্বোচ্চ ফল এটা।”

তিনি জানান, ‘এগুলো ইংরেজি বর্ণ দিয়েই নির্ধারণ করা হবে। তবে বর্ণগুলো এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আর মূল্যায়ন পদ্ধতি আগের যে সিদ্ধান্ত ছিল সেরকমই হবে।’

আগে গ্রেডিংগুলোর নাম দেয়া হয়েছিলো অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান ও প্রারম্ভিক। সর্বোচ্চ স্কেল ‘অনন্য’ বলতে শিক্ষার্থীর সব বিষয়ে পারদর্শিতার চূড়ান্ত স্তর। প্রারম্ভিক স্তর পারদর্শিতার সবচেয়ে নিচের স্তর। এখন শুধু এই নাম পরিবর্তন হবে।

‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১’ অনুযায়ী ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন পাঠক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে চালু হয়েছে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণীতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণীতে এটি চালু হবে। তার সাথে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি।

শিক্ষার্থী ও অভিভাকরা যা বলছেন
নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি এখন যারা নবম শ্রেণীতে পড়েন তাদের জন্য। তারা এখন নতুন পাঠক্রমে পড়ছেন। যখন এসএসসি পরীক্ষা দেবেন তাদের মূল্যায়ন হবে নতুন পদ্ধতিতে। তারা আবার যখন এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন সেই সময় থেকে এইচএসসিতে নতুন মূল্যায়ন চালু হবে।

ঢাকার আইডিয়াল স্কুলের নবম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী সাকিব আহমেদ বলেন, ‘আমরা নতুন পাঠক্রমে পড়া শুরু করেছি। মূল্যায়ন নিয়ে আমরা এখনো কিছু বুঝতে পারছি না। শুনেছি জিপিএ নাকি থাকবে না। স্যাররাও আমাদের ঠিক মতো কিছু বলতে পারছেন না।’

একই ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় ঢাকার আরো কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে।

ঢাকার একজন অভিভাবক রেজাউল আহমেদের দুই সন্তান অষ্টম এবং নবম শ্রেণীতে পড়ে। তার সন্তানেরা নতুন পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নতুন পাঠক্রমের বইগুলো আমি দেখেছি। শিক্ষকরা যদি বইগুলো ঠিকমতো পড়াতে পারেন তাহলে বইগুলো আমার কাছে ভালোই মনে হয়েছে। কিন্তু মূল্যায়ন পদ্ধতি আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। আমার সন্তানরাও এটা নিয়ে অন্ধকারে আছে। এটা আসলে আরো স্পষ্ট করা প্রয়োজন। আর বারবার মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন করলে বিভ্রান্তি বাড়ে।’

তার কথায়, ‘স্কুলের শিক্ষকদের হাতে ৩৫ নম্বরের মূল্যায়ন কোচিংকে আরো উৎসাহিত করবে। সরকার যে কোচিং থেকে বেরিয়ে আমার কথা বলছে সেটা সম্ভব হবে না। যদি ধরেও নিই যে শিক্ষকরা ন্যায় আচরণ করবেন তারপরও আতঙ্ক থেকে যাবে বাংলাদেশের প্রচলিত সংস্কৃতির কারণেই। আমার সন্তানরাও এটা নিয়ে আতঙ্কিত।’

দাউদকান্দির আরেকজন অভিভাবক নুরুন্নাহার খন্দকার বলেন, ‘সিস্টেমটা হয়তো ভালো। কিন্তু আমরা অভিভাবকরা বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছি না। আসলে এটা শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবক সবাইকে ভালেভাবে বুঝাতে হবে।’

আর স্কুলের শিক্ষকদের হাতে মূল্যায়নের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তো কোচিং ব্যবস্থা দূর করার কথা বলেছেন। কিন্তু এতে পরিস্থিতি কী হবে তা বুঝতে পারছি না।’

বাংলাদেশ শিক্ষার্থী অভিভাবক ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পারবে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি। কিন্তু বুঝতে কত দিন লাগে আর সেই সময়ে কী হয় তাই দেখার বিষয়। এখন শিক্ষার্থী তো দূরের কথা শিক্ষক, অভিভাবকরাই বুঝতে পারছেন না। সবাই একটা ধোঁয়াশার মধ্যে আছেন। শিক্ষার্থীরা রীতিমতো আতঙ্কে আছে।’

‘স্বর্ণ এবং চাল মাপার পাল্লা এক নয়’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘মূল্যায়নের গ্রেডিং স্তর যত বাড়বে তত ভালো। এতে মূল্যায়ন অধিকতর সঠিক হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো দক্ষতা ও অবকাঠামোর। শিক্ষকরা এই মূল্যায়নের জন্য সবাই দক্ষ কিনা। তাদের প্রশিক্ষণ দিলেও তারা কত দ্রুত আয়ত্ত করতে পারবেন বলে মনে হয় না। ফলে হিতে বিপরীতও হতে পারে।’

তার কথা, ‘যে পাল্লা দিয়ে চাল মাপবেন, সেই পাল্লা দিয়ে কি স্বর্ণও মাপবেন? সেটা তো হবে না। সঠিক মূল্যায়নে সঠিক পাল্লা দরকার। পাল্লা ঠিক না করে মূল্যায়ন শুরু করলে সঠিক মূল্যায়ন হবে না।’

তার কথায়, ‘শিক্ষকদের হাতে যে মূল্যায়নের ভার তা সঠিক করতে হলে ছাত্রসংখ্যা প্রতি ক্লাসে কম থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের এখানে গড়ে ৭০-৮০ জন করে। ফলে সঠিক মূল্যায়ন হবে বলে মনে করি না। এখানে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি এমনকি শিক্ষকদেরও প্রভাব থাকতে পারে। আমরা কি সেই নৈতিক মান অর্জন করেছি?’

তিনি বলেন, ‘আগেও দেখেছি, ধরেন বায়োলজির ১০০ নম্বরের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় যে ছাত্র ২২ নম্বর পেয়েছে সে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় ২৫ নম্বরের মধ্যে ২৪ পেয়েছে। সেটা কিভাবে সম্ভব? এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। সেই পরিস্থিতি যেন আবার না হয়।’

তার মতে, আরো অনেক বিষয় আছে। যেমন পাঁচ ঘণ্টার পরীক্ষা। শহর আর গ্রামের স্কুলের মধ্যে শিক্ষক ও অবকাঠামোর পার্থক্য এগুলো বুঝতে হবে।
সূত্র : ডয়চে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement