২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা কি পরীক্ষায় চ্যাট-জিপিটি ব্যবহার করতে পারবে

- ছবি - বিবিসি

ব্রিটেনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ এখন নিজেরা বোঝার চেষ্টা করছে পরীক্ষার্থীরা চ্যাট-জিপিটির মতো এআই উপকরণ কখন, কিভাবে, কতটা ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারে। অনেক ক্যাম্পাসে এটি ব্যবহারের গাইডলাইন দেয়া শুরু হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর এখন চাপ বাড়ছে তারা যেন শিক্ষার্থীদের এআই এর সঠিক ব্যবহার শেখাতে শুরু করে।

বাথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরা এখন পরীক্ষায় এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছেন।

“আমাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল ‘পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা কি এটি ব্যবহার করতে পারবে?” চ্যাট-জিপিটি প্রসঙ্গে বলেন বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস ফার্ন।

চ্যাট-জিপিটি হলো অনলাইন ভিত্তিক একটি এআই উপকরণ যা মুহূর্তের মধ্যে মানুষের মতো ভাষায় বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর হাজির করতে পারে, অর্টিকেল বা ই-মেইল লিখে দিতে পারে।

“উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মাল্টিপল চয়েস ধরনের প্রশ্নপত্রে অনেকগুলো সম্ভাব্য উত্তরের ভেতর থেকে সঠিক উত্তরটি বেছে নেয়ার মতো কাজ খুব ভালো করতে পারে চ্যাট-জিপিটি,” বলেন ফার্ন।

‘এই এআই টুলসটি এ কাজে এতটা ভালো করবে আমরা ভাবিনি। প্রায় শতভাগ সঠিক উত্তর দিতে পারছে।‘

কিন্তু জটিল কোনো প্রশ্নের বেলায়, যেখানে পরীক্ষার্থীকে অনেক কিছু ভাবতে হয়, চ্যাট-জিপিটি সুবিধা করতে পারছে না এবং পরীক্ষায় এমন প্রশ্নের সংখ্যাই বেশি থাকে।

যেমন তার বিভাগে ফাইনাল ইয়ারের এক পরীক্ষায় প্রশ্ন ছিল, ‘ওজন বেশি মানুষদের জন্য শরীরচর্চার জন্য কোন সময়টা সবচেয়ে উপযুক্ত সেটি বোঝা কেন গুরুত্বপূর্ণ?’

এই প্রশ্নের যে উত্তর চ্যাট-জিপিটি দিতে পারছে তা দেখলেই বোঝা যায় এটি কোনো পরীক্ষার্থী নিজে লেখেনি।

‘প্রথম দেখায় মনে হবে ভালোই- পরিচ্ছন্ন লেখা, পরিশীলিত ভাষা,’ বলেন জেমস। ‘কিন্তু উত্তরের বেশ কিছু অংশ এতটাই কাঁচা যে পড়ে মনে হবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয় এটি লিখেছে কোনো স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার্থী।’

অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেটা দেখা গেছে চ্যাট-জিপিটির চ্যাট-বট তার উত্তরের মুখবন্ধে অর্থাৎ শুরুর দিকে যে ধরনের বিষয়ের অবতারণা করছে উপসংহারে তা পুনরাবৃত্তি করছে, তবে কিছুটা ভিন্ন ভাষায়।

তথ্যের বা পরিসংখ্যানের যেসব সূত্র শিক্ষার্থীদের দিতে হয়, চ্যাট-জিপিটির দেয়া উত্তরে সেগুলো মনগড়া।

‘দেখে মনে হবে নিখুঁত – লেখকের নাম সঠিক, জার্নালের নামও দিয়েছে, নামগুলোও দারুণ, কিন্তু বাস্তবে সেসব জার্নাল বা লেখকের কোনো অস্তিত্ব নেই,’ বলেন জেমস।

‘আপনি খুব সহজেই বোকা বনে যেতে পারেন, আপনার মনে হতে পারে এগুলো সঠিক রেফারেন্স।’

ছয় মাস আগে যখন চ্যাট-জিপিটি বাজারে ছাড়া হয়, অনেক শিক্ষার্থী বিভ্রান্তিতে পড়ে যায় যে কখন, কোন ক্ষেত্রে তারা এটি ব্যবহার করতে পারবে আর কোথায় পারবে না।

‘আমি চ্যাট-জিপিটি ব্যবহার করতে খুবই উদগ্রীব। কিন্তু এ মুহূর্তে আমি ধরা পড়ার ভয়ে রয়েছি,’ বাথ ক্যাম্পাসে এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসের যাওয়ার ফাঁকে এক শিক্ষার্থী বিবিসিকে বলেন।

‘এখনো পরিষ্কার নয় চ্যাট-জিপিটির কোন ব্যবহারটি চিটিং হিসাবে বিবেচনা করা হবে।’
আরেক ছাত্র বলেন, ‘আপনি যদি পুরো অ্যাসাইনমেন্ট চ্যাট-জিপিটি থেকে তুলে দিয়ে জমা দেন, তাহলে তা চিটিং। কিন্তু এআইয়ের ওই উত্তর আপনার জন্য একটি গাইড হিসেবে কাজে লাগতে পারে।’

ক্যাম্পাসে এআই উৎসাহিত করছে সরকার।

ব্রিটেনের শিক্ষামন্ত্রী গিলিয়ান কিগান সোমবার এক অনুষ্ঠানে ভাষণে বলেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ‘স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এরই মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে শুরু করেছে।’ তিনি বলেন, পাঠক্রম পরিকল্পনায় এবং পরীক্ষার খাতা দেখার কাজে এইআই শিক্ষকদের কাজে লাগতে পারে।

ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান পর্যালোচনা করে যে সংস্থা তারা পরামর্শ দিয়েছে ছাত্ররা যাতে তাদের লেখাপড়ায় সঠিকভাবে এআই কাজে লাগাতে পারে সে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোগ নেয়া উচিৎ।

সংস্থাটি বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিৎ সেপ্টেম্বর মাসে যখন নতুন ছাত্র ভর্তি হবে বা পুরনো ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ফিরবে তখন তাদের জানানো উচিৎ কিভাবে এআইকে তারা কাজে লাগাতে পারে। এমনকি তারা বলছে, এআইকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোর্সের অংশ করা উচিৎ।

বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিংয়ের লেকচারার কিম ওয়াট চ্যাট-জিপিটিকে বর্ণনা করেছেন ‘টুলবক্সের মধ্যে আরেকটি টুল।’ তিনি জানান, তার বিভাগে কিছু শিক্ষার্থী এরই মধ্যে মার্কেটিং কৌশল তৈরির ওপর এক কোর্স-ওয়ার্কে চ্যাট-জিপিটি ব্যবহার করেছে।

কিম বলেন, চ্যাট-জিপিটি শিক্ষার্থীদের ‘কাজ শুরু’ করতে সাহায্য করতে পারে। ‘আমি তাদের বলছি তোমাদের মধ্যে যারা বুঝতে পারছে না কোথায় শুরু করতে হবে তারা এটির সাহায্য নিতে পারো,’ তিনি বলেন।

‘এটি (চ্যাট-জিপিটি) সবকিছুর উত্তর দিয়ে দেবে না কিন্তু কিছু ধারণা দিতে পারবে।’

‘বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণী ভাবনা-চিন্তা’
কিভাবে চ্যাট-জিপিটি কাজ করে তা দেখাতে কিম চ্যাট-বটকে নির্দেশ দিলেন তার নিজের নিজের মার্কেটিং পরিকল্পনা জানাতে।

যে উত্তর এলো তাতে চ্যাট-জিপিটির ব্র্যান্ড পরিচিতির সূচনা থেকে শুরু করে বাজারে আসা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে অনেকগুলো ধাপের কথা রয়েছে।

তা দেখে কম্পিউটার মনিটর থেকে চোখ তুলে কিম বললেন, ‘পরীক্ষায় এমন উত্তর লিখলে পাশ করা যাবে না।’

‘এভাবে লিখলে তা হবে অসম্পূর্ণ, খুবই সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা – এটি পড়ে বোঝা যাবে না এর পেছনে শিক্ষার্থীর পরিশ্রম রয়েছে। বিশ্লেষণমূলক চিন্তা-ভাবনা এই উত্তরে অনুপস্থিত।’

কিম বলেন, বিশেষ করে অটিজম বা ডিজলেক্সিয়ার মত উপসর্গে ভুগছেন যেসব শিক্ষার্থী অথবা ইংরেজি যাদের মাতৃভাষা নয়, তাদের জন্য চ্যাটজিপিটি খুবই কাজে লাগতে পারে।

তবে কোনো শিক্ষার্থী এটি ব্যবহার করতে চাইলে চ্যাট-জিপিটিকে করা তাদের প্রশ্ন এবং তার জবাব কোর্স-ওয়ার্কে জুড়ে দিতে হবে, যাতে বোঝা যায় সে এআইয়ের দেয়া উত্তরের ওপর ভিত্তি করে নিজে কতটা কাজ করেছে।

ব্রিটেনের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত বাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও চ্যাট-জিপিটি এবং অন্যান্য এআই টুলস ব্যবহারের নীতিমালা এখন চূড়ান্ত হয়নি। সেপ্টেম্বর থেকে তা কার্যকর করা হতে পারে।

এরপর একটি বিশেষ কমিটি বছরজুড়ে নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করবে যাতে দ্রুত পরিবর্তনশীল এআই প্রযুক্তির সাথে ঐ নীতিমালা পরিবর্তন করা যায়।

অনেক শিক্ষক এখন আসন্ন গ্রীষ্মে পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

বাথ ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা পর্যালোচনার মানদণ্ড নির্ধারণে যে কমিটি রয়েছে তার প্রধান ড. ক্রিস বোনফিল্ড বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের যে ধারণা তা হলো এ বছর পরীক্ষার্থীরা চ্যাট-জিপিটি ব্যবহার করবে না। কিন্তু কোনো শিক্ষক যদি তার শিক্ষার্থীদের তা ব্যবহারে অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তাদের যুক্তি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।

যেভাবে এই প্রযুক্তি এগুচ্ছে তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তবে বাথ বিশ্ববিদ্যালয় এআই নিষিদ্ধ করার কোনো কথা আর বলছে না।

‘এআই প্রযুক্তি এখন বাস্তবতা। একে অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই,’ বলেন ক্রিস।

‘আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেয়া ডিগ্রি সেকেলে হতে পারে না ...এই প্রযুক্তির প্রয়োগ নিয়ে আমাদের ভাবতেই হবে।’

‘খুবই বিপজ্জনক’
গত সপ্তাহে জেফরি হিন্টন, যাকে মনে করা হয় এআই প্রযুক্তির গডফাদার- গুগল থেকে পদত্যাগ করে বলেছেন, তিনি তার কাজের জন্য এখন অনুতপ্ত। কারণ তিনি মনে করেন, এআই চ্যাট-বট খুব তাড়াতাড়ি মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে।

অধ্যাপক ভেরেনা নিসার হেরিয়ট-ওয়াট বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী, যিনি গত ২০ বছর ধরে এআই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, তার ছাত্র-ছাত্রীরা ‘খুবই সৃজনশীলতার সাথে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।’

তিনি স্বীকার করেন, এআই চ্যাট-বট এখনো ততটা অগ্রসর হতে পারেনি এবং ‘ভুয়া তথ্য তৈরিতে এটিকে ব্যবহার করা যেতেই পারে যা খুবই উদ্বেগের একটি বিষয়- বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে।’

চ্যাট-জিপিটির আগের মডেলগুলো বাজারে ছাড়া হয়নি। কারণ ভয় ছিল এগুলো ‘খুবই বিপজ্জনক’, তিনি বলেন।

চ্যাট-জিপিটির নির্মাতা ওপেনএআই বলছে, ‘যেকোনো প্রযুক্তির মতই, এআইয়ের সাথেও অনেক ঝুঁকি জড়িত। তারা বলছে, সেই ঝুঁকি দূর করে এটিকে নিরাপদ ব্যবহারের উপযোগী করার কাজ চলছে।

চ্যাট-জিপিটি বাজারে আসার পর অন্যান্য বেশ কয়েকটি কোম্পানিও এআই প্রযুক্তিতে মনোনিবেশ করেছে। যেমন গুগল বার্ড নামে তাদের একটি এআই টুল বাজারে ছেড়েছে যেটি এখন শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্করা ব্যবহার করতে পারে।

‘আমি আশা করছি আমরা দ্রুত বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি বিভিন্ন ধরনের এআই দেখব এবং আশা করছি কিছু মডেল পাওয়া যাবে যেগুলোর ব্যবহার নিরাপদ হবে,’ বলেন ভেরেনা।

‘যে সব এআই মডেল ভুল তথ্য দিচ্ছে বা এমন তথ্য দিচ্ছে যা বিভ্রান্তি এবং ঘৃণা ছড়াতে পারে সেগুলোকে কিভাবে আটকানো যায় এই মুহূর্তে আমরা তা জানি না এবং সেটি বড় একটি সমস্যা।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement