রাবির ভর্তিতে আয়ের ৯ কোটি টাকা ভাগাভাগি খাতা মূল্যায়ন না করেও সম্মানী ব্যয় ১ কোটি
- আকরাম হোসাইন রাবি
- ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৭:০৪
রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের (রাবি) ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষের অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষায় মোট আয় হয়েছে ৯ কোটি ৩ লাখ আট হাজার টাকা। এ আয় থেকে প্রশ্ন, উত্তরপত্র তৈরিসহ শিক্ষকদের খাতা দেখা বাবদ ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৬২ লাখ ২৪ হাজার টাকা। যার মধ্যে ১ কোটি টাকা খাতা না দেখেও ব্যয় হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সিদ্ধান্তে খাতা প্রস্তুত, ইনভিজিলেটর, পরীক্ষা কমিটির নির্ধারিত ব্যয়, খাতা দেখার ব্যয়ের পর উদ্বৃত্ত অর্থ শিক্ষকদের মাঝে ভাগ করা হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। যদিও কাজ না করে সম্মানী আর এইভাবে অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন খোদ শিক্ষকরাই। ভর্তি পরীক্ষার এসব ব্যয় নিয়ে কয়েক বছর ধরে অডিটে আপত্তিও রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, এবারের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে তিনটি ইউনিটে ফরম তুলেছেন ৭৮ হাজার ৯০ জন। এর মধ্যে এ ইউনিটে ৩১ হাজার ১২৯ জন, বি ইউনিটে ১৫ হাজার ৭৩২ জন এবং সি ইউনিটে ৩১ হাজার ২২৯ জন ভর্তি ইচ্ছুক চূড়ান্ত আবেদন করেন, যা শিক্ষার্থীপ্রতি একটি ইউনিটের আবেদন ফি ছিল ১ হাজার ২ শ’ টাকা। সব মিলিয়ে পরীক্ষার্থীদের ফরম থেকে বিশ^বিদ্যালয়ের মোট আয় হয় ৯ কোটি ৩৭ লাখ ৮ হাজার টাকা। আর ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৬২ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন পেয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এ দিকে ব্যয়ের বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দফতর সূত্রে জানা গেছে, ভর্তি পরীক্ষার মোট আয় থেকে ৪০ শতাংশ কেন্দ্রীয় ফান্ডে জমা হয়। আর বাকি ৬০ শতাংশ অর্থ প্রশ্ন, উত্তরপত্র তৈরি, পরিদর্শক ফিসহ ২৩টি খাতে ব্যয় হয়। তবে অভিযোগ সব ব্যয়ের পর উদ্বৃত্ত অর্থ বণ্টন হয় শিক্ষকদের মধ্যে। গত কয়েক বছর ধরেই এমন নিয়মে অর্থ বণ্টন হয়ে আসছে।
এর মধ্যে ‘বিজ্ঞান, জীব ও ভূ-বিজ্ঞান, প্রকৌশল, কৃষি অনুষদভুক্ত সি ইউনিটে মোট ৫১৮ জন শিক্ষক পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে অংশ নেন। খাতা দেখা, স্ক্রুটিনি (নাম্বার যোগ করা) এবং কমিটির দায়িত্ব পালন করে মোট ১৫ হাজার টাকা করে পেয়েছেন একজন শিক্ষক। যার মধ্যে ৮ হাজার টাকা খাতা দেখা অথবা স্ক্রুটিনি। ২ হাজার টাকা কমিটিতে দায়িত্ব পালনের জন্য। আর বাকি ৫ হাজার টাকা উদ্বৃত্ত অর্থের ভাগ। সেই হিসাবে কাজ না করলেও সম্মানী ব্যয় ২৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
কলা, চারুকলা, সামাজিক বিজ্ঞান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটভুক্ত এ ইউনিটে এই অর্থ বেড়ে শিক্ষকপ্রতি কাজ ছাড়া ৯ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এ বছর এই অনুষদে ৪ শতাধিক শিক্ষক পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেই হিসাবে এই ইউনিটে কাজ অতিরিক্ত সম্মানী ব্যয় ৩৬ লাখ টাকা।
ব্যবসায় শিক্ষা ও ব্যবসায় প্রশাসনভুক্ত বি ইউনিটে এই অর্থের পরিমাণ বেড়ে শিক্ষকপ্রতি ৩০ হাজার। এ বছর শতাধিক শিক্ষক পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজের সাথে ছিলেন। সেই হিসাবে এই ইউনিটে কাজ অতিরিক্ত সম্মানী ব্যয় হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। এ ছাড়াও কো-অর্ডিনেটর প্রতি ৪০ হাজার, বিভাগীয় সভাপতিরা পেয়েছেন ৩০ হাজার টাকা করে। এভাবে তিন ইউনিট মিলে কাজের বাইরে সম্মানী ব্যয় প্রায় কোটি টাকা। সি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ড. একরামুল হামিদ ও এ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ড. আহসান কবীর জানান, ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সিদ্ধান্তে ব্যয়ের অতিরিক্ত অর্থ শিক্ষকদের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করা হয়েছে। আগেও এই নিয়ম ছিল। এর আগে শিক্ষকপ্রতি ৪০ হাজারের বেশি টাকাও পেয়েছেন।
এ দিকে এই অতিরিক্ত অর্থ ভাগাভাগি না হলে ফরমের দাম আরও কমানো যেত বলে দাবি শিক্ষকদের। এ প্রসঙ্গে আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইফতিখারুল আলম মাসউদ বলেন, নামে বেনামে অযৌক্তিক ব্যয় বাড়ার কারণে ভর্তি ফরমের দাম বেড়ে যায়। একদিকে শিক্ষার্থীদের কষ্ট বাড়ে অন্য দিকে কাজ না করেও শিক্ষকদের এই অর্থ ভাগাভাগি হয়, যা নীতিগতভাবে অনেকে মেনে নিতে পারেন না। বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অতিরিক্ত এই আয়টি কোনো খাত উল্লেখ করা হয় না। যে কারণে এই আয় নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থেকে যায়।
এর আগেও রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার অর্থ ব্যয়ের অসামঞ্জস্যতা নজরে এসেছে কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অডিট বিভাগের। এ নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই অডিট আপত্তি দিয়েছেন তারা। অভিযোগ রয়েছে ব্যয়ের ভাউচার নিয়েও। ২০১২-১৩ নিরীক্ষা বছরে নিরীক্ষার অনুচ্ছেদ ৫ এ আপত্তি ছিল, ভর্তি ফরম বিক্রয়লব্ধ ৭০ শতাংশ ৫ কোটি ৭৮ লাখ ৭২ হাজার ৭৫ টাকা ব্যয় স্বপক্ষে বিল/ভাউচার অডিটে উপস্থাপন করা হয়নি। এ ছাড়া অর্থগুলো অডিটেবল কিনা সে বিষয়ে জানেন না বলে দাবি করেছেন বিশ^বিদ্যালয়ের অডিট সেল প্রধান নিয়ামুল হক।
কাজ না করেও সম্মানী পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দফতরের পরিচালক আফসার আলী বলেন, লোকবল সঙ্কটের কারণে অর্থ ও হিসাব দফতর থেকে এই পুরো অর্থের ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হয় না। তাই নিয়ম অনুযায়ী ৬০ শতাংশ অর্থ অনুষদগুলোকে দিয়ে দেয়া হয়। ভর্তি পরীক্ষার ব্যয়ের যেসব খাত রয়েছে সেই অনুযায়ী তারা অর্থ ব্যয় করেন। তারা এই ব্যয়গুলো দেখাশুনা করেন।