২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ মাঘ ১৪৩১, ২৮ রজব ১৪৪৬
`

সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বারবার যে কারণে রাস্তায় নামতে হয়েছে

সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বারবার যে কারণে রাস্তায় নামতে হয়েছে - ছবি : সংগৃহীত

ঢাকার একাধিক সড়ক অবরোধ করে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে সরকারকে কয়েক ঘণ্টার আলটিমেটামের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধিভুক্ত সাত কলেজ আলাদা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

আপাতত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছে।

এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে আবারো রাস্তায় নেমে আসার প্রেক্ষাপটে এখন নতুন করে প্রশ্ন উঠছে গত কয়েক বছর ধরে এসব কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বিরতিতে রাস্তায় নামতে হচ্ছে কেন?

কারো কারো ধারণা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোর বাইরের কিছু বিষয়ও মাঝে মধ্যে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামার বিষয়ে ভূমিকা রেখেছে এবং এর কোনো কোনটির মধ্যে শিক্ষকদের ইন্ধনের অভিযোগও পাওয়া গেছে বিভিন্ন সময়ে। যদিও কলেজগুলোর শিক্ষকরা সবসময়ই এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছেন।

যদিও শিক্ষার্থীরা বলছেন, এসব কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি ছাড়াও বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজে এসে হেনস্থার শিকার হওয়া, রুটিন ও পরীক্ষা নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থাসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান না হওয়াটাই তাদের বারবার রাস্তায় নেমে আসার কারণ।

‘অন্তত ৩৫টি দাবি করেছি বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু কোনটিরই সমাধান হয়নি। কেউ দায়িত্ব নেয় না। ক্লাস রুটিন পর্যন্ত ঠিক মতো হয় না। এভাবে তো চলতে পারে না। এগুলো ঠিক হয় না বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি উঠেছে এবং সেটাই সমাধান,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন চলমান আন্দোলনের সংগঠকদের একজন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মো: রবিন ইসলাম।

এবারের অচলাবস্থার সূচনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক মামুন আহমেদের দুর্ব্যবহারকেই দায়ী করছেন ইসলাম।

রোববার সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি নিয়ে আহমেদের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি অসদাচরণ করেছেন বলে অভিযোগ করে আন্দোলন শুরু করে ওই শিক্ষার্থীরা। আহমেদ অবশ্য পরে তার ব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

শিক্ষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান বলছেন, সাত কলেজ পরিচালনায় যথাযথ মনোযোগ না দেয়ার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতার ঘাটতির কারণেই বারবার সঙ্কট তৈরি হচ্ছে এবং এসব সঙ্কটের জের ধরেই নিয়মিত বিরতিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামছে বলে মনে করেন তিনি।

এসব বিষয়ে দুটি কলেজের কয়েকজন শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি। আর একটি কলেজের অধ্যক্ষ নাম না প্রকাশ করার অনুরোধ করে শুধু বলেছেন ‘স্বনামধন্য এই কলেজগুলোর সুনামের প্রতি সুবিচার করা হলে বারবার এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না’।

যে প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৭ সালে সাতটি কলেজকে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল- সেই প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য জবাব নেই কারো কাছেই।

বরং অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গত নভেম্বরে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় বলেছিলেন যে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্তটি ছিল অপরিণামদর্শী। অপরিকল্পিতভাবে অধিভুক্ত করার ফলে শুরু থেকেই কলেজগুলোতে নানা সমস্যা ও সঙ্কট লেগে রয়েছে’।

জনশ্রুতি আছে তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আআমস আরেফিন সিদ্দিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদের মধ্যকার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরেই তখন ওই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়া হয়।

যদিও তখন আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।

‘এই আট বছরেও সাতটি কলেজের পরিচালনায়, বিশেষ করে ভর্তি, পরীক্ষা, কলেজ পরিদর্শন, মূল্যায়নসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিষয়ে সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,’ বলছিলেন তিতুমীর কলেজের একজন শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম।

এমনকি এই আট বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে অধিভুক্ত কলেজগুলোর জন্য আলাদা কোনো সেল বা ডেস্ক খুলতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এমনকি প্রশাসনিক ভবনে আলাদা কোনো শাখাও নেই যেখানে এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা গিয়ে দ্রুত সেবা পেতে পারে।

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলছেন, ‘লোকবলের ঘাটতি তো আছেই, তবে এর চেয়ে বড় সঙ্কট হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দায়িত্ব নিয়েও এসব কলেজগুলোর দিকে যথাযথ মনোযোগ দেয়নি বলেই দিনে দিনে সঙ্কট বেড়েছে’।

শিক্ষার্থীরা রাস্তায় কেন
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলছেন, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যায়। এরপর প্রায় দুই দশক ঢাবি কলেজ পরিচালনা কার্যক্রমের বাইরে থাকায় এ ধরনের কাজের সক্ষমতাও হারিয়ে গেছে।

‘ফলে হুট করে সাত কলেজকে নিয়ে আসার পর দেখা গেলো ঢাবির লোকবল ও সক্ষমতা নেই। যে কারণে শিক্ষার্থীরা দেখছে তাদের সাত কলেজ অন্য কলেজগুলোর চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে। এসব কারণেই ক্ষোভের জন্ম হয়েছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

এই সাতটি কলেজ হলো- ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।

এর মধ্যে কয়েকটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও পড়াশোনা হয়। আবার এসব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলেও এর শিক্ষক নিয়োগ হয় বিসিএস (সাধারণ) শিক্ষা ক্যাডার থেকে।

শিক্ষার্থীদের সংগঠকদের একজন রবিন ইসলাম বলছেন, কলেজের কোনো কাজই যথাসময়ে ও ঠিকমতো হয় না ঢাবি কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালি কারণে।

‘আমরা বার বার দাবি জানাই। কিন্তু সমাধান নেই। উল্টো আমাদের শিক্ষার্থীদের অসম্মান করা হয়। কিন্তু আমাদের তো প্রশাসনিক কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই যেতে হচ্ছে,’ বলছিলেন তিনি।

আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীদের অভিযোগ হলো এসব কলেজের ব্যস্ততার কারণে তাদের অনেক শিক্ষক যথাসময়ে ক্লাস ও পরীক্ষা নেন না। এসব কারণে ২০১৯ সালের জুলাই অধিভুক্ত সাতটি কলেজের অন্তর্ভুক্তি বাতিলের দাবি করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এরপরে কয়েক দফা নানা ইস্যুতে ওই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় এসে নানা কর্মসূচি বিভিন্ন সময়ে পালন করেছিল।

তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অক্টোবর আসে তারা আবার রাস্তায় নেমে আসে। তখন স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের এই দাবিকে কেন্দ্র করে কয়েক সপ্তাহ ধরে সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন বাদে প্রায় প্রতিদিন সকাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন মোড়ে জড়ো হচ্ছিল সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।

এমন প্রেক্ষাপটে সাত সরকারি কলেজের শিক্ষা ও প্রশাসনিক সমস্যা নিরসনে গত ২৪ অক্টোবর একটি কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

পরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ একটি সিদ্ধান্ত নেয় যে এই সাতটি সরকারি কলেজ দেখভালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই পুরোপুরি আলাদা একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে আলাদা রেজিস্ট্রারসহ অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকবেন। তবে এ কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তই থাকবে।

গত ৩১ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানালেও শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করে এই বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানায়।

এরপর নভেম্বরে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে নভেম্বরে ঢাকায় সড়ক অবরোধ শুরু করলে এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন মহলে। পরে সড়ক অবরোধ বন্ধ করে তারা নিজেরাই কলেজের ফটকে তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় লেখা ব্যানার টানিয়ে দেয়।

এর মধ্যেই রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রো-ভিসির দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছে দাবি করে নতুন করে আবার আন্দোলন শুরু হলো, যেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সাত কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সম্পর্ক চার ঘণ্টার মধ্যে বাতিল করে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছে।

অবশ্য এর মধ্যে সাত কলেজের সমস্যা সমাধানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত ১৩ সদস্যের কমিটি যে প্রতিবেদন তৈরি করেছিল সেটি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে।

বিশ্ববিদ্যালয় হলেও যেসব প্রশ্ন আসবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজগুলো স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দাবি করছে তা পূরণ হলে যেসব কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক আছে তাদের কী হবে সে বিষয়েও সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অন্যদিকে এসব কলেজের শিক্ষকরা এখন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার থেকে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় হলে তাদের কী হবে সেই প্রশ্নও আছে।

এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত হলেও এসব কলেজ কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকবে তা পরিষ্কার নয়। আপাতত শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু সেটা কিভাবে করা হবে, কারা সনদ দেবে, সেসব বিষয় এখনো পরিষ্কার হয়নি।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement