০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ৩ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

আবরার ফাহাদ হত্যা : বুয়েটে কী ঘটেছিল ৫ বছর আগে

আবরার ফাহাদ - ছবি - ইন্টারনেট

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড কেন্দ্র করে পাঁচ বছর আগে উত্তাল হয়ে উঠেছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিবাদ বিক্ষোভে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। এটি তখন শিরোনাম হয়েছিল বিবিসিসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।

এর জের ধরেই তীব্র আন্দোলনের মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

এবার আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী যে আন্দোলন গড়ে ওঠেছিল সেখানেও আন্দোলনকারীদের মিছিল, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার ও শ্লোগানে আবরার ফাহাদের নাম উঠে এসেছে বার বার।

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের সময় যে কয়েকটি ঘটনায় দলটির সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল, আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডকে তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন অনেকে।

একইসাথে আবরার হয়ে ওঠেন ‘ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী’ আন্দোলনের একটি প্রতীকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক রোবায়েত ফেরদৌস বলছেন, আবরার হত্যাকাণ্ড জাতির ইতিহাসের একটি ‘বাক পরিবর্তনকারী’ ঘটনা। কারণ এর জের ধরেই বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হয়েছে এবং এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠছে।

‘আবরার হত্যাকাণ্ড একটি মাইলফলক ঘটনা, যে ঘটনার কারণে ক্ষমতাসীনদের প্রতি তীব্র ক্ষোভের পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতির প্রতি চরম বিতৃষ্ণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। তখন ছাত্র রাজনীতি বন্ধের যে দাবি উঠেছিল, তাতে পুরো জাতির সমর্থন প্রকাশ পাচ্ছিল। এ থেকেই ঘটনাটির গুরুত্বের গভীরতা আঁচ করা যায়। ভারত বিরোধিতার বিষয়টি আছে। কিন্তু এর চেয়ে বড় বিষয় হলো, এটি সন্ত্রাস নির্ভর ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন রোবায়েত ফেরদৌস।

উল্লেখ্য, ওই হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তীব্র বিক্ষোভের জেরে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আটক করে মামলা দেয়া হয়েছিল।

পরে ওই হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড আর পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছিল ঢাকার একটি আদালত। তবে রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদনের এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান বলেছেন, আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আপিল দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেয়া হবে।

সবশেষ চলতি বছর ৩ সেপ্টেম্বর আবরার ফাহাদের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

হত্যাকাণ্ডটি যেভাবে হয়েছিল
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর নির্মম নির্যাতনে নিহত হন আবরার ফাহাদ।

তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ওই ঘটনার পর বিবিসির কাছে ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, তাতে বলা হয়েছিল যে সেদিনই কুষ্টিয়ার বাড়ি থেকে বুয়েটে এসে শেরে বাংলা হলে নিজের ১০১১ কক্ষে এসেছিলেন আবরার।

ফেসবুকে ভারতবিরোধী একটি পোস্টের জের ধরে রাত ৮টার দিকে তাকে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। পরে রাত ৩টার দিকে জানা যায় যে আবরারকে হত্যা করে একতলা ও দোতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি ফেলে রাখা হয়েছে।

পরে জানা যায় আবরারকে ‘শিবির আখ্যা’ দিয়ে দুই দফায় দু’টি কক্ষে নিয়ে মারধর করা হয় এবং পরে বুয়েট মেডিক্যালের ডাক্তার এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এর মধ্যে খবর পেয়ে রাত ২টার দিকে টহল পুলিশের একটি দল হল গেইটে গেলে তাদের হলে ঢুকতে দেয়া হয়নি। পরে ৪টার দিকে পুলিশ আবার হলে যায়। এরপর ডাক্তার মৃত ঘোষণার পর তারা লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয় যে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

পরে ঘটনাটির তদন্ত শেষে তখনকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সে সময় সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন যে আবরার ফাহাদকে শিবির হিসেবে সন্দেহ করার বিষয়টি হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়।

“অভিযুক্তদের সমীহ করে সালাম না দেয়ার বিষয়টিও আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যতম কারণ। তারা র‍্যাগিং-এর নামে আতঙ্ক তৈরি করেছে। হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তরা আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে অন্যদের মাঝেও আতঙ্ক তৈরি করতে চেয়েছিল, যাতে করে অন্য শিক্ষার্থীরাও তাদের সমীহ করে এবং সালাম দেয়। অভিযুক্তরা বুয়েটে ‘ভয়ের রাজত্ব’ কায়েম করার ধারাবাহিকতায় আবরার ফাহাদের ওপর হামলা করে,” বলেছিলেন মনিরুল ইসলাম।

পরে মামলার চার্জশিটে বলা হয়েছিল যে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের সাথে ১১ জন সরাসরি সম্পৃক্ত এবং বাকিরা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আটজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মামলার এজাহারে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাসহ প্রথমে ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তবে তদন্তের পরে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ জনে।

অন্যদিকে ছাত্রলীগের তখনকার সভাপতি আল নাহিয়ান জয় তখন বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘অনেক সময় অতিউৎসাহী কিছু নেতা-কর্মী ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য এ ধরনের কার্যক্রমে লিপ্ত হন। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এ ধরনের কার্যক্রম কোনোভাবে সমর্থন করা হবে না।’

প্রসঙ্গ : ভারতীয় আগ্রাসন
হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে ৫ অক্টোবর ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন আবরার ফাহাদ, যার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক।

তিনি লিখেছিলেন, ‘১. ৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মোংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মোংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।

২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েকবছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চাই না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।

৩. কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রফতানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব। ......”

তার হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটের শিক্ষার্থীদের অনেকেই দাবি করেন যে মূলত এই পোস্টের কারণেই আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।

পরে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনও ‘ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতাকারী’ হিসেবে আবরার ফাহাদকে উল্লেখ করেন।

বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আবরার হত্যাকাণ্ড
আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার খবর জাতীয় সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে আসে। কয়েকটি গণমাধ্যমে ঘটনার পর যে তুমুল ছাত্রবিক্ষোভ হচ্ছিলো তার খবরও নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে।

বিবিসি এ বিষয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশ করেছিল। বিবিসি নিউজে ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল যে চার ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আবরার ফাহাদকে।

তখন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছিলো ‘ভারতের সাথে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের পানি চুক্তির সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়’।

ওই রিপোর্টে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবির বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ পায়।

আবরারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের খবর প্রকাশ করেছিল গালফ নিউজ। আর গার্ডিয়ানে আবরারের বাবার বক্তব্য ও ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভের খবর প্রকাশিত হয়।

ওয়াশিংটন পোস্ট ও নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকাগুলোতেও আবরার হত্যা ও এর পরের ছাত্র বিক্ষোভের খবর প্রকাশিত হয়েছিল।

কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে ঘটনার পর এই হত্যার সাথে জড়িতদের বিচার করা হবে বলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী যে আশ্বাস দিয়েছিলেন সেই খবরও প্রকাশ করা হয়।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
ইসরাইলকে শিগগির গাজা গণহত্যার মূল্য দিতে হবে : এরদোগান আদালত প্রাঙ্গণে সাবের হোসেনকে ডিম নিক্ষেপ টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের মান্যবর চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের সাথে গোলাম পরওয়ারের সাক্ষাৎ আগস্টে মূল্যস্ফীতি কমেছে ১.১৭ শতাংশ : বিবিএস কর্ণফুলীর ওপর ১১৫৬০ কোটি টাকার রেল-সড়ক সেতুর অনুমোদন একনেকে গণহত্যার সাথে জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া যাবে না : আবদুল হালিম পাহাড়ে সহিংসতা : তদন্ত কমিটির বান্দরবান পরিদর্শন নিত্যপণ্যের বাজার মনিটরিংয়ে জেলায় জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স ডেঙ্গুতে আরো ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১২১৮ সেপ্টেম্বরে ৩৯২ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪২৬, আহত ৮১৩ জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনে আবারো সেরা রাসিক

সকল