২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
শীতকালেই পানিশূন্য বড়াল

চলনবিলের প্রাণের এ অবস্থা কেন?

-

নয়া দিগন্তের বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা জানান, পদ্মা-যমুনার প্লাবনভূমি ‘চলনবিলের প্রাণ’ বড়াল নদী শীতকালেই পানিশূন্য। এ নদী রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে ২০৪ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে পাবনার বেড়ার মোহনগঞ্জে যমুনায় মিলিত হয়েছে। চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসে স্লুইসগেট নির্মাণ করায় বড়াল মরা নদী। শরৎকালেই বিল, নদী ও খাঁড়িগুলো পানিশূন্য। এর প্রভাবে কমে গেছে মাছ, ঝিনুক, শামুক, কাঁকড়াসহ জলজ প্রাণীর বংশবিস্তার, উৎপাদন। পানির অভাবে বাণিজ্য ও চাষাবাদ বন্ধ। অঞ্চলের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও কৃষি অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। চলনবিলে ১৬টি নদী, ৩৯ বিল ও ২২টি খাল ছাড়াও অসংখ্য খাঁড়ি। এসব বিল ও খাল প্রাকৃতিক। বিল থেকেও ছোট নদীর উৎপত্তি। নদী থেকে খালও হয়েছে। চলনবিল অসংখ্য স্রোতের জাল। জালের প্রধান সূত্র হচ্ছে বড়াল। শরৎকালেই চলনবিলের বেশির ভাগ নদী-বিল-খাঁড়ি নাব্য সঙ্কটে ব্যবসায়-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে।

১৯৮৫ সালে চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসে নির্মাণ হয় স্লুইসগেট। ১৯৯৫-৯৬ সালে নাটোরের আটঘড়িতে স্লুইসগেট নির্মাণ করে পদ্মা নদী থেকে জন্ম নেয়া বড়াল নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করা হয়। গেটটি নির্মাণের ফলে উত্তর অংশে পানি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বড়াল দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ নন্দকুজা, অপর ভাগ বড়াল। বড়ালের উৎসমুখে চারঘাটে স্লুইসগেট নির্মাণ করায় বনপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় নদী অস্তিত্বহীন। বনপাড়ার ভাটিতে বড়াল নদীতে তৃতীয় ও চতুর্থ স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয় ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহরের দহপাড়ার কাছে। স্লুইসগেটটির উভয় পাশই শুকিয়ে যায় শুষ্ক মৌসুমে। অনেকেই নদী দখল করে ঘরবাড়ি, দোকান-গুদাম উঠিয়েছেন। নদীর মধ্যে চাষাবাদ করা হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি চলাচল বন্ধ করে দিয়ে মাছ চাষ হচ্ছে। রাজশাহীর চারঘাট থেকে জন্ম নিয়ে বড়াল নাটোরের গুরুদাসপুরের কাছে আত্রাই নদীতে মিশেছে। এ অংশকে ‘আপার বড়াল’ বলা হয়। দৈর্ঘ্য ৮৪ কিলোমিটার। বড়াইগ্রামের আটঘড়ি থেকে বেরিয়ে বনপাড়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর ও সাঁথিয়া হয়ে শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ী ঘাটের ভাটিতে হুরাসাগর নদে মিলিত হয়ে যমুনায় মিশেছে। এ অংশ ‘লোয়ার’ বড়াল। দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার। নদীর অববাহিকা এক হাজার ৫৪২ বর্গকিলোমিটার। আপার বড়ালের গড় প্রস্থ ৬০ মিটার ও গড় গভীরতা পাঁচ মিটার। লোয়ার বড়ালের গড় প্রস্থ ১২০ মিটার, গভীরতা ৯ দশমিক ৯০ মিটার। বড়ালের দু’টি শাখা নদী মুসা খাঁ ও নন্দকুজা। মুসা খাঁ নদীর উৎপত্তি নাটোরের বাগাতিপাড়া হাঁপানিয়ায়। পাইকপাড়া গিয়ে মুসা খাঁ নদী থেকে উৎপত্তি হয়েছে নারদের। নদীটি নন্দকুজা নদী হয়ে আত্রাই নদীতে মিশেছে। বড়ালের একটি প্রশাখা নাগর। বড়ালের শাখা নন্দকুজার উৎপত্তি আটঘড়িতে। নদীটি নাটোর হয়ে গুরুদাসপুরের চাঁচকৈরে আত্রাই নদীর সাথে মিশেছে। নন্দকুজা ও আত্রাইয়ের মিলিত প্রবাহ ‘গুমানি’ নাম ধারণ করে চাটমোহরের নুরনগরে বড়ালে মিশে বাঘাবাড়ী গেছে। ভাটিতে বড়াল ও করতোয়ার মিলিত প্রবাহ হুরাসাগর নাম নিয়ে আট কিলোমিটার ভাটিতে যমুনায় মিলেছে। অববাহিকার ইতিহাস সমৃদ্ধ। আশির দশক পর্যন্ত বড়াল ছিল যোগাযোগ ও বাণিজ্যের চালিকাশক্তি। ছিল সংস্কৃতি ও বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। বড় পণ্যবাহী নৌকা, বার্জ, জাহাজ ও কার্গো জাহাজে পণ্য আনা-নেয়া হতো বড়ালে। চলত বড় লঞ্চ ও স্টিমার। এ অঞ্চলের ৯০ শতাংশ অধিবাসী ছিল বড়াল নদীতে নির্ভরশীল। চারঘাটে স্লুইসগেট নির্মাণে প্রবাহ হ্রাস পেতে থেকে। ফলে পরিবর্তিত হতে থাকে পরিবেশ ও পাড়ের জীবিকা। বড়াল অববাহিকার অর্থনীতি কৃষি, মৎস্য ও গবাদিনির্ভর। ধান, চাল, মসুর, খেসারি, সরিষা, কলাই, পাট প্রভৃতি উৎপাদনের জন্য অববাহিকার সুখ্যাতি। পাড়ের ফসল যেত চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে।

১৯৬০ সালের দশকে বড়ালে যখন পানির প্রবাহ স্বাভাবিক, তখন শুষ্ক মৌসুমে নদী তীরের জমিতে পানি পাওয়ার পাম্প দিয়ে সেচ দেয়া হতো। নালা বা খালে প্রবাহ ছিল। বিলের জমিতে সেচ দেয়া যেত। ক্লোজার নির্মাণ করার পরে পানি না থাকায় সেচ শ্যালো বা ডিপ মেশিন-নির্ভর। নদী অববাহিকায় পানির স্তর নেমে গেছে। বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশাল চলনবিলে। বিলের প্রসিদ্ধ মৎস্য সম্পদ হ্রাস পেয়েছে। হাঁস পালন কমেছে। বিশাল গো-চারণ ভূমিতে মাষকলাই ও খেসারি ঘাস জন্মে না। গবাদিপশু মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আগের মতো বড়ালে পানিপ্রবাহ না থাকায় বিল শুকিয়ে যায়। এতে চাষি ও মৎস্যজীবীদের সমস্যায় পড়তে হয়। জেলে বিলুপ্তপ্রায়। চলনবিলে ৭০ থেকে ৭৫ প্রকার মাছ পাওয়া যেত। অনেক প্রজাতির বিলুপ্তির তালিকায় নাম উঠেছে।


আরো সংবাদ



premium cement