১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সিরাজ ভাই

সিরাজ ভাই। - ছবি : নয়া দিগন্ত

সিরাজ ভাই চিরতরে চলে গেছেন; এটা বিশ্বাসই হয় না। গত ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে একদিন এ খবর পাই। বিশ্বাসই হচ্ছিল না এ কথা শুনে। অনেক আগে তার ছাত্র ছিলাম। তিনি আমাদের মাস্টার্স ক্লাসে পড়াতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তিনি শিক্ষক ছিলেন। তিনিই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র, যিনি মাস্টার্সে এ বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। তার আগে কেউ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্সে ইংরেজিতে প্রথম বিভাগ পাননি।
তখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসন আমল। সিরাজ ভাই চট্টগ্রাম থেকে এসেছিলেন রাজধানী ঢাকায়। উঠেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ফজলুল হক মুসলিম হলে। কিন্তু রাতে তল্লাশি অভিযানে তিনি বহিরাগত হিসেবে আটক হন। আমরা সবেমাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি, তখন তার সে মন্দ খবর শুনতে পেলাম। সিরাজ ভাইয়ের বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার থানায়।

অনেক বছর পর একবার আমি ঢাকায় যাওয়ার পথে তার সাথে দেখা হয়। ট্রেন কী কারণে জানি না, বিলম্ব করেছে। তখন আমরা দু’জন রিকশায় করে ঢাকার বাসের উদ্দেশে রওনা হলাম। কুমিল্লায় রিকশায় যেতে যেতে অনেক কথাই হয়েছিল। ‘সিরাজ ভাই’-এর পুরো নাম মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রবীণতম শিক্ষক প্রফেসর মোহাম্মদ আলীর অন্যতম প্রিয় ছাত্র ছিলেন। এটা আমরা জানতাম। চলতি শতকের প্রথম দিকে সিরাজ ভাই ঢাকার শ্যামলীস্থ ‘আশা’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তখন তিনি আমার কর্মস্থল দৈনিক নয়া দিগন্তের মতিঝিলস্থ অফিসে এসেছিলেন। ওই সময়ে তার সাথে কিছু কথা হয়েছিল।

সিরাজ ভাই ছিলেন খুব ভালো ছাত্র এবং পুলিশ অফিসার। তিনি হঠাৎ করে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে পুলিশ অফিসার হয়ে গেছেন। আমরা তো শুনে হতবাক। তার মতো শান্তশিষ্ট মানুষ পুলিশ অফিসার কিভাবে হবেন; এটাই আমরা স্বাভাবিকভাবেই ভাবছিলাম। এরপর আরেক চমক; সিরাজ ভাই ইংরেজি সাহিত্যে ডক্টরেট করার জন্য ভারতের চন্ডীগড়স্থ পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন। তার আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ বিভাগে ফিরেছিলেন অল্প সময়ের জন্য। সিরাজ ভাই নির্ধারিত সময়ের আগে ভারত থেকে ফিরে এলেন। এসেই আমাদের ক্লাস নিতে নিতে বললেন, ‘সেখানে গিয়েছিলাম সাহিত্যিক জোসেফ কনরাডের ওপর পড়াশোনা করতে; এটা করা আমার ঘরেও সম্ভব। এজন্য চন্ডীগড় যাওয়ার কোনো দরকার হয় না।’

পাহাড়িয়া এলাকা চন্ডীগড়ে দুধ পাওয়া যেত প্রচুর। তাই সিরাজ ভাই সেখানে দুধ আর রুটি খেতেন খুব। উল্লেখ্য, ভারতের পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যের যৌথ রাজধানী শহর চন্ডীগড়। ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি শিখ প্রধান পাঞ্জাব থেকে পৃথক হয়ে হিন্দু প্রধান ও হিন্দিভাষী হরিয়ানার সৃষ্টি। হরিয়ানা রাজ্যের সীমান্ত ভারতের কেন্দ্রীয় রাজধানী, দিল্লীর খুব কাছে। স্মর্তব্য, পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরে অবস্থিত, বিখ্যাত ও সুপ্রাচীন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ই বেশি পরিচিত এ নামে। সিরাজ ভাইয়ের কথা শুনে মনে পড়ল চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান ও প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখক, চট্টগ্রাম সিটি কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর এ এ রেজাউল করিম চৌধুরী নাকি বলেছিলেন, আমেরিকায় পান পাওয়া যায় না’। অতএব, আমার ফুলব্রাইট স্কলারশিপের দরকার নাই।’ তখন এ দামি স্কলারশিপ পাওয়া ছিল দুর্লভ ব্যাপার। যা হোক, সিরাজ ভাই বলেছিলেন, আরো আগেই আমার থিসিস সাবমিট করে চলে আসতে পারতাম। কনরাড-এর উপর পড়াশোনার জন্য সুদূর চন্ডীগড় যেতে হয় না।’

আমাকে কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিলেন ব্যক্তিগতভাবে সিরাজ ভাইয়ের সাথে পড়াশোনার বিষয়ে যোগাযোগ করার জন্য। তবে আমি করি নাই। সিরাজ ভাই ছিলেন খুব মেধাবী ছাত্র। তার সহপাঠী সুজিত কুমার দত্তও একই বিভাগের শিক্ষক ছিলেন।

সিরাজ ভাইয়ের একটি বক্তৃতার কথা আজও মনে আছে। এটি তিনি দিয়েছিলেন অধুনালুপ্ত বাংলাদেশ পরিষদ মিলনায়তনে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিপরীতে বিখ্যাত মুসলিম ইনস্টিটিউট হল। এতে ঢোকার পথে এক পাশে ছিল বাংলাদেশ পরিষদ মিলনায়তন, আর এক পাশে কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি। ১৯৭৮ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি, শীতকালে এখানে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। সাবেক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ড. আর আই চৌধুরী এতে উপস্থিত ছিলেন। তিনি এক সময়ের আওয়ামী লীগার হলেও পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার আমলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং চার বছর মেয়াদ পূর্ণ করেন। সিরাজ ভাইয়ের প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর মোহাম্মদ আলীও উক্ত আলোচনা সভায় ছিলেন।

সিরাজ ভাই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উপর জোর দেন এবং তার এক হিন্দু প্রাইমারি শিক্ষকের প্রশংসা করে বলেন, তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। সিরাজ ভাই আরো বলেন, ওই শিক্ষক কোনো দিন মুসলমান বা ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ অসাম্প্রদায়িক মতাদর্শ বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। ওই আলোচনা সভায় আমার মতো অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

সিরাজ ভাই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা; নিছক কোনো ধর্ম নয়।’ তিনি মনে করতেন, ইসলাম একটি অবিভাজ্য, অখণ্ডনীয় ও চিরন্তন মানব আদর্শ। তিনি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সমর্থক ছিলেন না। সিরাজ ভাইয়ের বিভাগীয় সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন সিনিয়র শিক্ষক মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ, আব্দুল ওয়াসে, কাজী মোস্তাইন বিল্লাহ, শিরিন হক, নিলুফার সুলতানা প্রমুখ। জুনিয়রদের মধ্যে ছিলেন নেরুন ইয়াকুব, মাসুদ মাহমুদ, তপন জ্যোতি বড়ুয়া, গোলাম সারোয়ার চৌধুরী, জাহাঙ্গীর বিন সরওয়ার, মোহাম্মদ আলী চৌধুরী প্রমুখ।


আরো সংবাদ



premium cement
রাজশাহীতে আরো ২ মামলায় গ্রেফতার সাবেক এমপি আসাদ স্কুলে ভর্তির লটারির ফল জানা যাবে যেভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে তাদের রুখে দিতে হবে : জাহিদ হোসেন পতিত স্বৈরশাসকের জন্য ভারত মায়াকান্না করছে ‘অপশক্তিকে রুখে দিয়ে দেশকে বাঁচাতে হবে’ বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের আহ্বান ফেনীতে মুক্তিপণ না দেয়ায় শিশু খুন, গ্রেফতার ৩ কিশোর ড. ইউনূসের সাথে এসএফও প্রতিনিধিদলের বৈঠক সিরিজ নিশ্চিত করতে চায় দক্ষিণ আফ্রিকা, সমতা লক্ষ্য পাকিস্তানের হালাল পণ্যের বাজার প্রসারে বাংলাদেশের সাথে কাজ করবে মালয়েশিয়া শমী কায়সারের জামিন স্থগিত

সকল