২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
আড়িপাতার ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ

মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুন্ণের শঙ্কা

-

যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়। তবে আমাদের দেশে বৈশ্বিক যেকোনো সূচকে আগের চেয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা খর্বের প্রবণতা বেড়েছে। যদিও তা সংবিধান ও আইনসম্মত নয়। যেমন, গত এক যুগে বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। তবে কারা এসব ফোনালাপ রেকর্ড করছে তাদের চিহ্নিত করা হয়নি।
এবার জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, আইনসম্মতভাবে মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট মাধ্যমে যোগাযোগে আড়িপাতার ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অথচ সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও অন্যান্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। ফলে সরকারের এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার কথা বললেও আইনসম্মতভাবে আড়িপাতার ব্যবস্থা চালু করা হলে এর অপব্যবহারের শঙ্কা রয়েই যায়। এতে ভিন্নমত দমনে এটি সরকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার কারণে যদি বিশেষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে আড়িপাতা হয়; সেটি আদালতের মাধ্যমে হওয়া বাঞ্ছনীয়। তা ছাড়া আড়িপাতার বিষয়টি সার্বিকভাবে সংবিধান প্রদত্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ করবে।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজে প্রকাশিত গত ১০ জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরাইলের সাবেক এক গোয়েন্দা কমান্ডার পরিচালিত কোম্পানি থেকে নজরদারির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কিনেছে বাংলাদেশ সরকার। গত বছর বাংলাদেশে প্রায় ৬০ কোটি টাকার প্রযুক্তি আনা হয়েছে। নজরদারির প্রযুক্তি কেনার বিষয়ে টিআইবি অভিমত হলো- নজরদারিসংশ্নিষ্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অনুপস্থিতিতে এমন প্রযুক্তির ব্যবহারে ব্যক্তিগত তথ্যের ব্যবহারের গোপনীয়তা, সুরক্ষা এবং বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ একাধিক সাংবিধানিক অধিকার খর্ব হওয়ার ব্যাপক ঝুঁকি সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৭১ ধারা অনুযায়ী, ফোনে আড়িপাতার অপরাধ প্রমাণিত হলে অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান আছে। তবে এ আইনে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে বিশেষ বিধানের কথাও বলা হয়েছে। বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার প্রয়োজনে আড়িপাতার মতো কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
একটি সহযোগী দৈনিককে এ বিষয়ে আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘সারা বিশ্বে কর্তৃত্ববাদী সরকারের অর্থই হলো বাকস্বাধীনতা, যোগাযোগের স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতার মতো অধিকারগুলো খর্ব বা সঙ্কুচিত করা। পক্ষান্তরে, গণতান্ত্রিক ও আইনের শাসনের দেশে এসব করা হয় না। কিন্তু আমাদের এখানে সরকার কর্তৃত্বকে আরো সুসংহত করতে চায়। তাই এটাই স্বাভাবিক, সংবিধান ও আইনের শাসন উপেক্ষা করে সরকার তার সমালোচক ও বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে বেআইনিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করবে। সরকার আগে যন্ত্রপাতি কিনেছে। এখন পছন্দমাফিক আইন করবে। পরে সংবাদমাধ্যমসহ সবার মানবাধিকার আরো খর্ব ও সঙ্কুচিত করবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও আড়িপাতা হয়। তবে সেই আড়িপাতার আগে সেসব দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে পুলিশকে আদালতের কাছ থেকে যথোপযুক্ত প্রাথমিক তথ্যাদি পেশ করতে হয়। আদালত অনুমতি দিলে তা করা হয়। আমাদের দেশেও এ ধরনের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। তাহলে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত থাকবে।’ আর সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘এখন যে বিধান রয়েছে অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে বিশেষ ব্যক্তি যারা জঙ্গি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তাদের নজরদারি করা যায়। এর বাইরে গিয়ে যদি কাউকে নজরদারি করতে আড়িপাতা হয় সেটি অবশ্যই বেআইনি। আর আইন করে যে আড়িপাতার বৈধতা দেয়ার কথা উঠেছে সেটি সঠিক নয়। এটি গ্রহণযোগ্য হবে না।’
আইনজ্ঞদের মতো আমরাও মনে করি, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের এই উদ্যোগ নেয়ার আগে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ এবং নাগরিকসমাজের সাথে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা করা দরকার। এরপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। তা না হলে জনমনে ধারণা বদ্ধমূল হবে যে এটি ভিন্নমত দমনেই করা হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল