২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
বিশ^বিদ্যালয় বেকার তৈরির কারখানা

কর্মমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই

-

দেশের উচ্চশিক্ষার সমস্যা নিয়ে মন্তব্য করেছেন একজন মন্ত্রী। শিক্ষামন্ত্রী নন, তিনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। গত শনিবার একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেকার তৈরির কারখানা হয়ে গেছে। মন্ত্রী তার মন্তব্যের যথার্থতা নিশ্চিত করতে উদাহরণও পেশ করেন। তিনি বলেন, পিয়ন পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলে সেখানে কমপক্ষে দুই হাজার আবেদন জমা পড়বে। আবেদনকারীদের মধ্যে দেখা যাবে প্রায় এক হাজার এমএ পাস আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শিক্ষা নিয়ে পিয়ন হতে যাচ্ছেন। এত কষ্ট করে পড়াশোনা করলেও বাস্তবে এটি কোনো কাজে লাগল না। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর শিক্ষার্থীরা উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছেন, রাষ্ট্রের সম্পদ ও মেধার অপচয় হচ্ছে।
মাত্র দিন দশেক আগে দেশে প্রথমবারের মতো চালু করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানের মেট্রোরেল ব্যবস্থা। এ রেলের প্রথম চালক ছিলেন এক তরুণী। তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রিধারী। বিষয়টি সামাজিকমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়। মন্ত্রী যে অর্থে বিশ^বিদ্যালয়ের ডিগ্রি কাজে না লাগার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সামাজিকমাধ্যমে মতামত দেয়া উদারপন্থীরা কিন্তু তার বিপরীত কথাই বলতে চেয়েছেন। তারা বলেন, যেকোনো শ্রমই মর্যাদার। উচ্চশিক্ষা নিয়ে রেলের চালক হলে সেটি অসম্মানের হবে কেন? বিষয়টি শ্রমের মর্যাদার সাথে কতটা সংশ্লিষ্ট, তা নিয়ে আমাদের সংশয় আছে।
শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া দরকার যাতে শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকে তার অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান খুঁজে পান এবং সেই খাতে সর্বোত্তম অবদান রাখতে পারেন। আমাদের ধারণা, যে নারী মেট্রোরেলের ড্রাইভার পদে চাকরি করছেন তিনি যদি নিজের শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো কাজে যোগ দেয়ার সুযোগ পেতেন তাহলে তার শিক্ষা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারতেন। এভাবে আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে বহু উচ্চশিক্ষিত তরুণ নিজের শিক্ষা পেশাগত জীবনে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এটি কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর ব্যর্থতা নয়, এটি রাষ্ট্রের দুর্বলতা, সরকারের ব্যর্থতা।
আমরা জানি, বিজ্ঞান শিক্ষায় আমরা পিছিয়ে আছি। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতের মতো বিষয়গুলো নিয়ে পড়ালেখা করেন আমাদের বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাত্র ৯ শতাংশ। অথচ এসব বিষয় নিয়ে প্রতিবেশী ভারতে পড়ে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী, মালয়েশিয়ায় ৪৪ ও সিঙ্গাপুরে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী। সেই মুষ্টিমেয় শিক্ষার্থীকেও আমরা কাজে লাগাতে পারছি না তাদের শিক্ষার নি¤œমানের কারণে। মানহীন শিক্ষার কারণে উচ্চদক্ষ ও সমস্যা সমাধানের যোগ্য মানবসম্পদ আমরা তৈরি করতে পারিনি। সে জন্য অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে দেশের বাইরে থেকে অভিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হচ্ছে এবং তাদের বেতন-ভাতাদি বাবদ প্রতি বছর শত শত কোটি ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এমনই এক অবস্থায় মন্ত্রীর উপলব্ধি যথার্থই। কিন্তু টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর এমন মন্তব্য জাতির জন্য হতাশার। মন্ত্রী অবশ্য এ কথাও বলেছেন, পাঠ্যসূচি পরিবর্তন করা হচ্ছে, যুগোপযোগী করা হচ্ছে, যেন বেকার সৃষ্টি না হয়। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এ সরকার যা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে তার কোনোটিই লাগসই হয়নি; বরং লেজেগোবরে হয়েছে। এখন বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার পাঠ্যসূচি পরিবর্তন বা সংস্কারের নামে কী করা হবে বা হচ্ছে- তা জাতির সামনে স্পষ্ট নয়।
চাকরির বাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি প্রায়োগিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা আমাদের আছে। এ নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে ও হচ্ছে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখন কিছু প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় দেশের ও বিদেশের চাকরির বাজারের চাহিদামাফিক যোগ্য গ্র্যাজুয়েট তৈরির পদক্ষেপ নিচ্ছে। অগ্রগতি বলতে এটুকুই।
সঙ্গত কারণে এ কথা বলা বাড়াবাড়ি হবে না যে, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের হাতে শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মতো একটি জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়ে আর কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না হওয়াই সম্ভবত ভালো।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল