২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
চিকিৎসাবর্জ্য ফের বাজারে আসছে

জনস্বাস্থ্যে বিপর্যয় ঘটতে পারে

-

দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত নিজেই অসুস্থ বললে খুব একটা ভুল হবে না। এ খাতের এমন একটি দিকও নেই যা সুষ্ঠুভাবে চলছে। বড় বড় হাসপাতাল, ক্লিনিক, ব্লাডব্যাংক থেকে শুরু করে চিকিৎসা-সংক্রান্ত ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সবগুলোই অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতার আখড়া। করোনা মহামারীর সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যেসব দুর্নীতির চিত্র সামনে এসেছে তাকে অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। এমনকি সাম্প্রতিক ডেঙ্গুর প্রকোপকালেও রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসুবিধা দিতে পারেনি আমাদের হাসপাতালগুলো।
সর্বশেষ ভয়ঙ্কর এক উদ্বেগজনক খবর পাওয়া গেল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা থেকে। গবেষণায় জানা গেছে, চিকিৎসাবর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াকরণে কার্যকর আইন-বিধিমালা প্রণয়ন, বাস্তবায়নের ঘাটতি, অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে সৃষ্ট সুশাসনের অভাবে নাগরিক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ প্রতিনিয়ত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। ব্যবহৃত চিকিৎসাসামগ্রী যেগুলো একবার ব্যবহারের পর নষ্ট করে ফেলার কথা- সেসব বর্জ্য নষ্ট না করে নতুন করে ধুয়েমুছে মোড়কজাত করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। ওষুধের দোকান, বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পৌঁছে যাচ্ছে সেসব ব্যবহৃত কাচের বোতল, সিরিঞ্জ, ব্লেড, ছুরি, কাঁচি, রক্তের ব্যাগ, প্লাস্টিকের নল, স্যালাইন ব্যাগ ও ধাতব নানা উপকরণ। আমরা নাগরিক সমাজ সেই পুরনো জিনিস, যা আদৌ জীবাণুমুক্ত নয়- কিনে নিচ্ছি নতুনের দামে। এতে শুধু বাড়তি অর্থ ব্যয় হচ্ছে তাই নয়, মানুষ প্রতারিত হচ্ছে এবং নতুন করে জীবাণু সংক্রমিত হচ্ছে। পরিণতিতে জীবনহানির মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। সেই সাথে নতুন ধরনের মহামারীর আবির্ভাব হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
স্বাস্থ্য খাতে কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া যে কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত তারও দৃষ্টান্ত বেরিয়ে এসেছে টিআইবির গবেষণায়। দেখা গেছে, ৫৫ শতাংশ চিকিৎসাবর্জ্যকর্মী নিয়োগ পান দুর্নীতির মাধ্যমে।
আমাদের দেশে আইন-কানুন, বিধি-বিধানের কোনো অভাব নেই। অভাব শুধু একটি- আইনের প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন নেই। নেই কোনো বিধিবদ্ধ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিও। কাগজ-কলমে চিকিৎসাবর্জ্য ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত আইনি ও বিধিমালা ঠিকই আছে; কিন্তু তার কার্যকর বাস্তবায়ন বা জবাবদিহি নেই। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা প্রণয়ন করা হয় ২০০৮ সালে। কিন্তু গত ১৪ বছরেও ওই বিধি অনুযায়ী ‘কর্তৃপক্ষ’ গঠন করা হয়নি। এ দায়িত্ব যাদের কাঁধে তারা কেমন দায়িত্ব পালন করছেন এ ঘটনা থেকে তা স্পষ্ট। টিআইবি বলেছে, দায়িত্ব পালনে রয়েছে অবহেলা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি-অনিয়মসহ সার্বিক অরাজকতা।
এই অরাজক অবস্থা শুধু স্বাস্থ্য খাতেই নয়; বরং দেশের সর্বত্র। রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ প্রতিটি সেক্টরে অরাজকতার নমুনা এখন আর খুঁজে বের করতে হয় না। খোলা চোখেই তা লক্ষযোগ্য।
তবে স্বাস্থ্য খাতে উল্লিøøখিত পরিস্থিতির উন্নয়নে টিআইবি কিছু সুপারিশও দিয়েছে। তাতে চিকিৎসাবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ‘কর্তৃপক্ষ’ গঠনসহ বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে ‘চিকিৎসাবর্জ্য সম্পর্কিত বিধিমালা সংশোধনের কথাও।
প্রশ্ন হলো, যে দেশে এখনো ব্যাঙের ছাতার মতো হাজার হাজার অবৈধ ক্লিনিক, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাডব্যাংক অবাধে কার্যক্রম চালিয়ে যায়, অবৈধ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বরাদ্দে রীতিমতো বাণিজ্য চলে, যে দেশে দায়িত্ব পালনে ‘অরাজক’ অবস্থাই যুগের পর যুগ ধরে চলতে পারে, সেখানে টিআইবির ওইসব সুপারিশ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবেন এমন দায়িত্ববান কেউ কি আদৌ আছেন!
আমরা আশাবাদী হতে পারি; কিন্তু সে আশা সব সময়ের মতোই নৈরাশ্যে পরিণত হবে এটি ধরে নিয়েই।


আরো সংবাদ



premium cement