২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
বদলে যাওয়া চলনবিলের প্রকৃতি

জীবিকার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র

-

৩৬৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের চলনবিল অঞ্চল দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে হয়ে উঠতে পারে বিপুল সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র। এখানকার উৎপাদিত কৃষিপণ্য, মৎস্য ও জলজসম্পদ এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেছে। তবে আধুনিক পদ্ধতিতে ধান চাষসহ অন্যসব ফসল আবাদ করা হলে দেশের খাদ্যঘাটতি নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে উত্তরের এই শস্যভাণ্ডার।
গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও মৌমাছি পালন, শামুক, কাঁকড়া, চিংড়ি চাষ করে এ অঞ্চলের মানুষ নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে সচেষ্ট হয়েছেন। আর কুটির শিল্প গড়ে অনেকে নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ অঞ্চলের উৎপাদিত কুটির শিল্পজাত দ্রব্য এ জনপদের অর্থনীতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। ইতোমধ্যে অনেকের ভাগ্য সচলও হয়েছে। এমন বাস্তবতায় পরিকল্পিত কর্মসূচি নেয়া হলে তা খুলে দিতে পারে চলনবিলের অভাবী জনগোষ্ঠীর জন্য অপার সম্ভাবনার দুয়ার।
নয়া দিগন্তে প্রকাশিত বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কয়েক দশক আগের সেই চলনবিলের চিরচেনা রূপ এখন আর নেই। বর্তমান সময়ে শুষ্ক মৌসুমের আগেই বিল, নদী ও খাড়ি শুকিয়ে জেগে ওঠে বিস্তীর্ণ মাঠ। সেখানে রসুন, পেঁয়াজ, সরিষা, মিষ্টিকুমড়া, গাজর, লাউ, শিমসহ নানা জাতের সবজির আবাদ হয়। এ অঞ্চলে উৎপাদিত শাক-সবজি, মধু, কাঁকড়া, শুঁটকি ও কুচিয়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে রফতানি হচ্ছে।
বর্ষা মৌসুমে চলনবিলে শুধু থৈ থৈ পানি। বর্ষা শেষে সব বিলাঞ্চল শুষ্ক ধু ধু মাঠ আর ফসলের ক্ষেত। খাল খনন করে পানি নিষ্কাশনের ফলে শুষ্ক মৌসুমে বিলে পানির দেখা মেলা ভার। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের পরিবর্তে বিলে অসংখ্য পুকুর কেটে হাইব্রিড মাছ ও কুচিয়ার চাষ হচ্ছে। বিল শুকিয়ে যাওয়ায় বিস্তৃত জমিতে ধানসহ বিভিন্ন ফসল, সবজি ও বাঙ্গি-তরমুজজাতীয় ফলের আবাদ হচ্ছে।
কার্তিক-অগ্রহায়ণে চলনবিল অঞ্চলের পানি নেমে গেলে সমতল ভূমি জেগে ওঠে। তখন জমিতে চাষ হয় সরিষা, রসুন, কালাই, ধান, লাউ, কপি, আনাজ, গাজর, বেগুন, শশা, ক্ষীরাসহ হরেক রকমের রবিশস্য। এরপর চলে বোরো ধানের জন্য প্রস্তুতি। পৌষ-মাঘে ধান রোপণের কাজ শেষ হয়। কৃষি উৎপাদনে সেচের জন্য কৃষকরা ব্যবহার করেন ভূগর্ভস্থ পানি। বৈশাখ মাসে ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়। শুধু ধান নয়, অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে আবাদ হয় শাক-সবজি। ফলে এ অঞ্চলে মাছ, সরিষা, মধুসহ নানা প্রকার মৌসুমি ফসল উৎপাদন হচ্ছে।
সর্ববৃহৎ জলাভূমি চলনবিলের আশপাশের মানুষ এক সময় বছরের প্রায় পাঁচ মাস বেকার বসে থাকতেন; বিশেষ করে বর্ষাকালে। এ সময় অনেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু বর্তমানে মৎস্যভাণ্ডার-খ্যাত চলনবিলে এখন তেমন মাছ পাওয়া যায় না। এ কারণে বাধ্য হয়ে অন্য কাজে মনোযোগী হয়েছেন তারা। ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের কাজ করছেন অনেকে। কিন্তু পুঁজি সঙ্কটে খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না তারা। এ অঞ্চলের কুটির শিল্পের বিকাশে সরকারি- বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে ও আধুনিক কৃষি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে চলনবিল ঘিরে গ্রামীণ অর্থনীতি গতি পাবে। ফলে বিপুল মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতো আমরাও মনে করি, বোরো মৌসুমে চলনবিল অঞ্চলে বিপুল ধান উৎপাদন করে দেশে খাদ্যঘাটতি বহুলাংশে পূরণ করা সম্ভব। এ জন্য বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। শুধু সুষ্ঠু পানি নিষ্কাশন ও সেচের ব্যবস্থা করা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পুনর্নির্মাণ করা হলে চলনবিল অঞ্চলের কৃষকদের ধান উৎপাদনের পরিমাণ বাড়বে। সঙ্গত কারণে এ কথা বলা যায়, একটু পরিকল্পনার ছাপ থাকলে বদলে যাওয়া চলনবিলের প্রকৃতিও খুলে দিতে পারে অপার সম্ভাবনার দুয়ার।


আরো সংবাদ



premium cement