২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
পালিত হলো বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস

মাটির কান্না কেউ শোনে না

-

গতকাল ৫ ডিসেম্বর বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বেশ আড়ম্বরের সাথে পালিত হলো বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। এবারে এ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মাটি : খাদ্যের সূচনা যেখানে’। বিশিষ্টজন এ দিনে মূল্যবান বাণী দিয়েছেন, আয়োজন হয়েছে সভা, সেমিনার র‌্যালি ইত্যাদির। হয়েছে পুরস্কার দেয়া-নেয়া। গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু মাটির গুণাগুণ নষ্ট হওয়া রোধে ও তা বাড়াতে কার্যকর কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা হবে তার আভাস ইঙ্গিত পাওয়া গেল না।
মাটিতেই জন্মে উদ্ভিদ ও খাদ্যশস্য। মাটিতে অঙ্কুরিত প্রতিটি গাছের চারা সূর্যের আলো থেকে নানা জটিল প্রক্রিয়ায় তৈরি করে শর্করা। এই শর্করার ওপরই বিশে^র তাবৎ প্রাণীর খাদ্যচক্র নির্ভরশীল। মাটির প্রাণশক্তি নষ্ট হয়ে গেলে এই খাদ্যচক্র ধ্বংস হবে এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় নেমে আসবে। এ জন্যই মাটির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর মৃত্তিকা দিবস পালন করা হয়।
অনেকে মাটিকে বলেন এক বিরাট ল্যাবরেটরি। কারণ, মাটি হলো ভৌত-রাসায়নিক ও অণুজৈবিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার এক জটিল আধার। কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, পানি ও পুষ্টির মতো উপাদানগুলোর প্রাকৃতিক ব্যবহারের এক বিস্ময়কর কারিগর। মাটিই প্রাকৃতিক পানি পরিশোধনের অকৃত্রিম কারখানা। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এর চেয়ে বড় কোনো উপায় তৈরি করা মানুষের সাধ্যাতীত। খাদ্য উৎপাদন ছাড়াও মানুষকে বসবাসসহ কত বিচিত্র প্রয়োজনে মাটির ওপর নির্ভর করতে হয় তা কে না জানে।
অথচ এই মাটিই বিশেষ করে বাংলাদেশে সবচেয়ে উপেক্ষিত। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের মাটিতে যে পরিমাণ জৈব পদার্থ থাকা দরকার তা নেই। ক্রমাগত ফসল ফলানো, অপরিকল্পিত চাষাবাদ, অতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার, ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দূষণ, ব্যাপক হারে বনভূমি ধ্বংস ইত্যাদি নানা কারণে মাটিতে জৈবপদার্থের ঘাটতি দেখা দিয়েছে অর্থাৎ মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। ইটভাটার জন্য মাটির উপরের অংশ তুলে নেয়া ছাড়াও মাটির টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে মাটি এখন হুমকির মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো প্রাকৃতিক কারণও আছে যার ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ সামান্যই।
বলা হয়, ফসল ফলানোর জন্য মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ গড়ে ২ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। দেশের মোট জমির প্রায় ৭৯ শতাংশে জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে। মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) গবেষণায় মাটির উর্বরা শক্তি কমে যাওয়ার তথ্য স্পষ্ট। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কোনো? না, তেমন কিছু করা হয়নি। এমনকি কাজে অকাজে নানা আইন-কানুন তৈরি করা হলেও তিন ফসলি জমি রক্ষার জন্য অতি জরুরি ভূমি ব্যবহার আইন বছরের পর বছর ‘খসড়া আইন’ হিসেবে ফাইলবন্দী হয়ে আছে।
আমাদের আবাদি জমি কমে যাচ্ছে অব্যাহতভাবে। সমৃদ্ধ আগামীর কথা বলে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের নামে তিন ফসলি কৃষিজমি চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছে তথাকথিত উন্নয়নের পেটে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার ভুয়া তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হলেও সত্য এটাই যে, এখনো আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। জনসংখ্যা বাড়ছে, আবাদি জমি কমছে আর নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরাশক্তি। ফলে ভবিষ্যতে ফসলের উৎপাদনও কমবে। আমাদের শিল্প খাতের ওপর নির্ভর করার মতো সক্ষমতা নেই। অর্থনীতির বিরাট অংশ এখনো কৃষিসংশ্লিষ্ট। আমাদের বেশির ভাগ মানুষের জীবন ও জীবিকা পুরোপুরি মাটি তথা কৃষি অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল, যা আপাতত পাল্টানোর কোনো উপায় নেই। সুতরাং সময় থাকতে মাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই।


আরো সংবাদ



premium cement