২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে শৈথিল্য

কারো মাথাব্যথা নেই

-

খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে। কোথাও এমন কোনো খাবার নেই যা ভেজালমুক্ত। প্রতিদিন লাখো মানুষ ভেজাল খাবার খেয়ে অসুস্থ হচ্ছে। ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশুমার। চিকিৎসাব্যয় বাড়ছে লাগামছাড়া। হাসপাতালে উপচে পড়া রোগী। ওষুধের চড়া দাম ও অত্যধিক চিকিৎসাব্যয়ে অসংখ্য মানুষ বিনাচিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। কিন্তু ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো হয়। দু’য়েকজন দোকানি বা কিছু প্রতিষ্ঠানকে কিঞ্চিৎ জরিমানা বা কিছু ভেজাল খাবার ড্রেনে ফেলা হয়। মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হয়। নিজেদের কৃতিত্বে কর্তারা বিরাট আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। তারপর যে কে সেই!
ফলে দেশজুড়ে খাবারে ভেজাল দেয়া ও বিপণনের গোটা প্রক্রিয়া অবাধে চলতে থাকে। অথচ খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে দেশে জোরদার আইন আছে। এক দশকেরও বেশি আগে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন’ করা হয়। তৈরি হয় নিরাপদ খাদ্য-বিধিমালা। আছে ‘নিরাপদ খাদ্য (স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সংরক্ষণ) প্রবিধানমালা-২০১৮’। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। গঠন করা হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এদের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। আইনও আছে বই-কেতাবে, বাস্তবে প্রয়োগ নেই। যারা প্রয়োগ করবেন তারা জনগণের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান এই বলে যে, আমাদের সক্রিয় ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এটি শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয়, লজ্জাকরও।
গত মঙ্গলবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী খাদ্যে ভেজাল প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ভেজাল খাদ্যে দেশ ভরে গেছে। চাল, ডাল, মশলা, মাছ থেকে শুরু করে প্রায় সব খাদ্যে বিষ মেশানো হচ্ছে। ভেজাল খাবারের কারণে দেশে ওষুধের ব্যবসায় এত বেড়েছে। মানুষের দেহে ক্যান্সার, কিডনিসহ বড় বড় জটিল রোগ এখন দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। হাসপাতালের ফ্লোরেও রোগীদের জায়গা হয় না।
আরো অনেক কথার সাথে মন্ত্রী এ কথাও বলেন, এভাবে তো চলতে দেয়া যায় না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ জীবন দিতে হলে ভেজাল কারবারিদের এখনই থামিয়ে দিতে হবে। খাদ্যে ভেজাল দেয়া বন্ধ করতে হবে।
মাতৃভাষায় বলা মাননীয় মন্ত্রীর সব কথাই বোধগম্য। শুধু বোঝা গেল না, কাকে উদ্দেশ্য করে তিনি এসব কথা বললেন। তিনি নিজে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা তার দায়িত্ব। তাহলে তিনি কাকে বলছেন, ভেজালকারীদের এখনই থামাতে হবে?
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি একটি দৈনিকে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, আমাদের নীতি-নৈতিকতা, মানবতাবোধের অবক্ষয় হয়েছে। লাভের জন্য আমরা মানুষকে বিষ খাওয়াতে পিছপা হই না।
নীতি-নৈতিকতা, মানবতাবোধের এ অবক্ষয় ঠেকাতে করণীয় কী। ক্যাব সভাপতি বললেন, সামাজিক আন্দোলন দরকার। জনসচেতনতার পাশাপাশি শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বক্তব্য যথার্থ। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও শাস্তি দেয়া, নিয়মিত ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখাও খুবই জরুরি। কিন্তু সামাজিক আন্দোলন কখনো দেশজুড়ে দীর্ঘমেয়াদে চলতে পারে না। কোনো নির্দিষ্ট ইস্যুতে সাময়িকভাবে সীমিত স্থানজুড়ে আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে। তাতে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু দাবি দাওয়া হয়তো পূরণ হয়; কিন্তু সামাজিক আন্দোলনে সমাজের চরিত্রগত স্থায়ী পরিবর্তন হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। এ ক্ষেত্রে টেকসই ব্যবস্থা কী সেটি আমাদের বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী কেউই বলেন না। আমাদের বিশ্বাস, একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের, এমনকি একটি গোটা সমাজের চরিত্রে স্থায়ী পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ জন্য দরকার একেবারে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিশুদের নৈতিক ও মানবিক গুণ অর্জনের শিক্ষা দেয়া। তা হলেই মানবিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে। সেটি হবে এমন সমাজ যেখানে প্রতিটি মানুষ তার যেকোনো কাজে সমাজের অন্য কারো বিন্দুমাত্র ক্ষতি হচ্ছে কি না সে বিষয়ে ভাববে।


আরো সংবাদ



premium cement