২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
সন্তুষ্টি প্রকাশের সময়ই সীমান্ত হত্যা

প্রতিকার চাইতে হবে সরকারকে

-

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী হত্যা নিয়মিত ঘটছে। বিদেশী বাহিনীর হাতে হত্যা গুরুতর বিষয় হলেও আমাদের জন্য এটি গা-সওয়া হয়ে গেছে। বড়জোর সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হবে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রতিবেদনে এর সংখ্যা উল্লেখ করবে। সচরাচর কোনো উচ্চবাচ্য হয় না। আমরা ধরে নিয়েছি, ভারত সীমান্তে বাংলাদেশীদের লাশ পড়বে, এটি নিয়তি। বিষয়টি উপহাস হয়ে যায়, যখন বিএসএফ প্রধান কিংবা ভারত সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এমন প্রতিশ্রুতি দেয়ার মধ্যেও দেখা যায়, সীমান্ত হত্যা সমানতালে চলছে। এতে জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদা ম্লান হয়।
এবার ভারতের কাছ থেকে এই নিষ্ঠুর আচরণের ভিন্ন নজির সৃষ্টি হলো। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার দিনের ভারত সফরের সময়ই এক স্কুলছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। বুধবার সকালে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লিতে সীমান্তে প্রাণহানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বলে সন্তোষ প্রকাশের দিনই রাত ১০টায় দিনাজপুরে হত্যাকাণ্ড ঘটায় বিএসএফ। যদিও হত্যা কমায় সন্তোষ প্রকাশ সমীচীন নয়; কারণ মানুষের মৃত্যু কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। দরকার, হত্যার প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি; যা ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে।
সীমান্ত হত্যার পর বিএসএফ ভুক্তভোগীর পরিবারের প্রতিও মানবিক আচরণ করে না। আইনের কথা বলে লাশ দিতে গড়িমসি করে। দিনাজপুরে স্কুলছাত্র হত্যার সময় আরো একজন গুলিবিদ্ধ হন। একজন নিখোঁজও হয়েছেন। এত কিছুর পরও ভুল স্বীকার বা অনুতপ্ত হতে দেখা যায় না বিএসএফকে। গত ৩১ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে একজনকে গুলি করে হত্যা করেছে তারা। এর আগে ২৪ আগস্ট পঞ্চগড়ে আরেকজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। এসব ঘটছে বিএসএফ প্রধান পঙ্কজ কুমার সিংয়ের মধ্য-জুলাইয়ে পাঁচ দিনের সফরে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতির পর।
দু’দেশের সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা যখন সীমান্তে হত্যা কমায় সন্তোষ প্রকাশ করছিলেন; তখন প্রকৃতপক্ষে সীমান্ত পরিস্থিতি কেমন? সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিসংখ্যান দেখলে প্রকৃত পরিস্থিতি আঁচ করা যায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে বিএসএফ আট বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। ২০২১ সালে ১৯ জন, ২০২০ সালে ৪৯ জন, ২০১৯ সালে ৪৩ জন, ২০১৮ সালে ১৪ জন ও ২০১৭ সালে ২৪ জনকে হত্যা করেছে। ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে মোট ১৫৭ জনকে হত্যা করেছে বিএসএফ। তাদের ৯০ শতাংশকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অথচ মারণঘাতী অস্ত্র প্রয়োগ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে ভারত। বাস্তবে ট্রিগারহ্যাপি নীতি নিয়েছে দেশটি। দিনাজপুরে বাংলাদেশী কিশোরকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক গুলি করে হত্যা করা হয়। এভাবে একে ফরটি সেভেন বা মারণঘাতী যেকোনো আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করা হলে পরিণতি কী তা বিএসএফ সদস্যদের অজানা নয়। আসলে বাংলাদেশীদের প্রতি ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা একটি আগ্রাসী ও শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। হত্যা ছাড়া অপহরণ-নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটিয়ে যাচ্ছে। ২০১৭ থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ১৩৭ জনকে নির্যাতন এবং ১১৯ জনকে অপহরণ করেছে বিএসএফ।
উল্লিখিত পরিসংখ্যান থেকে এ কথা বলা যায়, দু’দেশের সরকারি পর্যায়ের আলাপ আলোচনা বিবৃতিতে প্রকাশিত বক্তব্যের সাথে সীমান্ত পরিস্থিতির কোনো মিল নেই। ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন, মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) সম্প্রতি বলেছে, সীমান্ত হত্যা কমছে না। সংস্থাটি স্পষ্টভাবে এটি স্বীকার করেছে- এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঘটছে। এমনকি মাসুমের সচিব কিরিটি রায় ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের এ নিয়ে আপত্তি নেই সেরকমভাবে। ভারতের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলছে না।’ দুর্ভাগ্য হচ্ছে- সরকার যদি নিজের নাগরিকদের বাঁচাতে আন্তরিক না হয় তাহলে প্রতিকার পাওয়া দূরপরাহত। আমরা প্রত্যাশা করব, সরকার এমন হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে। এই জঘন্য কর্মের নিন্দা জানাবে। সর্বোপরি ভারত সরকারের কাছে প্রতিকার চাইবে।


আরো সংবাদ



premium cement