২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
সেবা খাতে ঘুষ দুর্নীতি

প্রতিরোধে সরকারের অঙ্গীকার নেই

-

বাংলাদেশে ঘুষের বিনিময়ে সরকারের সেবা পেতে হয়, এটি সবার জানা। এখানে কোনো একটি সেবা ঘুষ ছাড়া যদি আদায় করা যায় তা অনেকটাই আশ্চর্যের বিষয় হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সেবাদানকারী সরকারি অফিসে ঘুষের বিস্তৃতি কেমন? দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ পার্ট টিআইবি গত এক বছরে এ খাতের দুর্নীতি নিয়ে জরিপ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, এগুলোতে আকণ্ঠ ঘুষ দুর্নীতি রয়েছে। তবে এর বিরুদ্ধে সরকারের তদারকি ব্যবস্থা অকার্যকর। অন্য দিকে সেবাগ্রহীতারাও ঘুষ দেয়াই নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিজে থেকে অনৈতিকতাকে গ্রহণ করে নিয়েছে।
২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এক বছরে সেবা নিতে গিয়ে নাগরিকরা যে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন টিআইবি গত সোমবার ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ-২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তা তুলে ধরে। মোট ১৭টি সেবা খাতের ওপর জরিপ করতে গিয়ে তারা এ সময়ে ১৫ হাজার ৪৭৪ পরিবার থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করে। এদের ৭১ শতাংশ পরিবার সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে টিআইবি ২০১৭ সালে একই জরিপ করে। তুলনা করে দেখা যাচ্ছে ওই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ দুর্নীতি বেড়েছে। আবার ঘুষের অঙ্কের টাকাও বেড়েছে। আগে গড়ে প্রতিটি পরিবারকে পাঁচ হাজার ৯৩০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এবার সেটি বেড়ে হয়েছে ছয় হাজার ৬৩৬ টাকা।
প্রতিবেদনে সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে মানুষ প্রতিদিন তার বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতির শিকার সর্বোচ্চ ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার। এরপর ধারাবাহিকভাবে রয়েছে পাসপোর্ট অধিদফতর ৭০ শতাংশ, বিআরটিএ ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ, বিচারিক সেবা ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ, স্বাস্থ্য ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও ভূমিসেবা ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এ ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সেবা নিতে গিয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত হয়রানি, দুর্ব্যবহার ও অব্যবস্থাপনার শিকার হন। এ কারণে মানুষের মনে একটি সাধারণ ধারণা হয়েছে যে, ভোগান্তি ছাড়া সরকারি সেবা মিলে না। জরিপেও উঠে এসেছে- ৭২ শতাংশ পরিবার মনে করে, ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না। আবার ৫৯ শতাংশ পরিবার ঘুষ দেয় হয়রানি ও নানামাত্রিক ঝামেলা এড়াতে।
সরকার নিজে থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে নিচের দিকে কর্মকর্তারাও প্রতিনিয়ত এ নীতিকথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়। বিশেষ করে সরকারের দায়িত্বশীল বহু ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় সরাসরি অনিয়ম দুর্নীতি ও ঘুষের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। দেখা যায়, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা পদোন্নতিসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছে। কর্মচারীদের মধ্যে নীতিবোধের জাগরণের জন্য সরকার শুদ্ধাচার পুরস্কার চালু করেছে। এ ধরনের কর্মসূচি পুরোপুরি উপহাসের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দেখা গেছে, অপরাধের জন্য তিরস্কার পাওয়া ব্যক্তিকে শুদ্ধাচার পুরস্কার দেয়া হচ্ছে।
সরকারের কর্মকর্তাদের পুরস্কার দেয়ার নীতিটি মোটা দাগে এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এবারের জরিপে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টেকনাফের বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ পরপর কয়েক বছর পুলিশের সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছেন। অথচ তিনি ওই বছরগুলোতে শতাধিক ক্রসফায়ার করেছেন। কোন ধরনের কর্মদক্ষতা ও দেশপ্রেমের জন্য তাকে এ পুরস্কার দেয়া হলো? সেই প্রশ্ন থেকে গেল। টিআইবি শুদ্ধাচার পুরস্কার দেয়া বন্ধ করার সুপারিশ করেছে এ ধরনের অবিবেচনাপ্রসূত পুরস্কার নিয়েও সরকারের নতুন মূল্যায়ন থাকতে হবে।
সরকারের সেবা খাত থেকে ঘুষ দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন দলকে স্পষ্ট করে জাতির সামনে সেই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তারপর বিভিন্ন পর্যায়ে সেটি বাস্তবায়নে সুনর্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে। বর্তমান সরকারের দীর্ঘ তিন মেয়াদে দলটিকে এমন নীতি বাস্তবায়নে দেশপ্রেম নিয়ে অগ্রসর হতে দেখা যায়নি। বরং দুর্নীতি করে কোনো শাস্তি না পাওয়ার নীতিই এখনো কার্যকর। এ নীতির পরিবর্তন ছাড়া সরকারি সেবা খাত থেকে প্রকৃত সেবা কোনোভাবেই আশা করা যায় না।


আরো সংবাদ



premium cement