২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
মাঠপ্রশাসনে রাজনীতির প্রভাব

দলনিরপেক্ষ হওয়া জরুরি

-

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র এক অপরিহার্য অঙ্গ। যে দেশে আমলাতন্ত্র যত বেশি সুশৃঙ্খল-দক্ষ, সেই দেশ তত বেশি নাগরিকবান্ধব। কিন্তু বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তার ওপর গত তিন দশকে সচিবালয় থেকে শুরু করে মাঠপ্রশাসনে কর্মরত বহু সরকারি কর্মকর্তা দলনিরপেক্ষ না হওয়ায় আমাদের জনপ্রশাসন দিন দিন নাজুক হয়ে পড়ছে। এ প্রবণতা বিগত ১২ বছরে আরো প্রবল হয়েছে।
সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২৫ উপবিধি (সংশোধিত) ২০০২ সালের সংশোধিত বিধিতে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন না এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা থেকে তাদের বিরত থাকতে বলা হয়েছে। বিধি অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের রাজনীতি করার বিধান নেই। কিন্তু গত এক যুগে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় সচিবালয় থেকে শুরু করে তৃণমূলে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের সুনজরে থাকতে তীব্র প্রতিযোগিতা করতে দেখা যাচ্ছে। স্মরণযোগ্য, আমাদের আমলাতন্ত্রে দলীয় রাজনীতি দৃশ্যমান হয় ১৯৯৬ সালে; তদানীন্তন সকরারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে রাজপথে জনতার মঞ্চ গঠন করে অনেক আমলা সরকারবিরোধী অবস্থান নেন। এখন সবপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা কে কত সরকারের কাছের লোক তার প্রমাণ দিতে চলছে প্রাণান্তকর চেষ্টা। ক্ষেত্রবিশেষে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কার্যালয় শাসকদলের রাজনৈতিক কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে। অবস্থার এতটাই অবনতি হয়েছে যে, সরকারি চাকরিবিধি ভঙ্গ করে ক্ষমতাসীন দলের কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন অনেকে।
সরকারি দলের নেতাকর্মী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতো দলীয় কর্মীর আচরণ করায় অনিবার্যভাবে স্বার্থের দ্বন্দ্বে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি দলের নেতাদের সাথে জড়িয়ে পড়ছেন মাঠপ্রশাসনের অনেকে। এতে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের সাথে আমলাদের অপ্রীতিকর ঘটনা আগের যেকোনো সময়ে চেয়ে বেড়েছে। অন্য দিকে সরকারঘনিষ্ঠ মাঠপ্রশাসনের বহু কর্মকর্তা জনগণের সাথে বিধিবহির্ভূত আচরণ করছেন।
লক্ষণীয়, দীর্ঘ দিন থেকে দলীয়করণের প্রভাবে প্রশাসনের অনেকে শৃঙ্খলাবহির্র্ভূত কাজ করছেন। কিছু কর্মকর্তা শাসকদলের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বিনা কারণে সাধারণ মানুষকে নাজেহাল করছেন। আর যারা সততার সাথে আচরণবিধি মেনে কাজ করতে চান তাদের সরকারবিরোধী তকমা দিয়ে কোণঠাসা করা হচ্ছে।
মাঠপ্রশাসনের অবস্থা কতটা সঙ্গীন টের পাওয়া যায় সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায়। টেকনাফের ইউএনওর অশালীন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। উচ্চ আদালত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দরজা খোলা রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন।
টেকনাফে উপহারের ঘর নির্মাণের বিষয়ে ঢাকার একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ইউএনও স্থানীয় সাংবাদিকের সাথে অশালীন-অসংযত আচরণ করেন। ইউএনওর অশোভন আচরণের বিষয়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘এটি কোনো ভাষা হতে পারে না, মাস্তানদের চেয়েও খারাপ ভাষা ব্যবহার করেছেন তিনি। ইউএনওর ভাষা খুব আপত্তিকর, দুঃখজনক, এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো রং হেডেড পারসন ছাড়া এ রকম ভাষায় কথা বলতে পারে না।’ গত বছর সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে ইউএনওকে ‘স্যার’ সম্বোধন না করায় এক সাংবাদিকের ওপর চড়াও হয়েছিলেন তিনি। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ না বলে ‘আপা’ বলায় ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে এক ব্যবসায়ীকে আহত করা হয়। আর মাদারীপুরের ডাসারে আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে ইউএনও হন প্রধান অতিথি।
সবার জানা, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার একধরনের দুর্নীতি। আইনের মধ্যে থেকে সাধ্যমতো সেবা দিতে হবে তাদের। সরকারি কর্মচারীদের অসদাচরণের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৩(খ) বিধি অনুসারে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিবিদদের ওপর আমলাদের আধিপত্য এর অন্যতম কারণ। জনগণের ভোটের অধিকার না থাকায় এটি প্রমাণিত হয় যে, দেশে আমলাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিদের বিজয় অনেকটা নির্ভর করে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর। ফলে জনপ্রতিনিধিরা আমলাদের হুকুম তামিল করছেন। এ পরিস্থিতির উত্তরণে প্রশাসনের দলনিরপেক্ষ হওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রশাসন পরিচালনা করতে হবে রাষ্ট্রীয় আচরণবিধি দিয়ে; দলীয় দৃষ্টিকোণ মুক্ত না হলে তা হবে সবার জন্য অকল্যাণকর।


আরো সংবাদ



premium cement