২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
রোহিঙ্গা অগ্রাধিকার তালিকায় নেই

প্রত্যাবাসন ইস্যু চাপা পড়ছে

-

রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে উচ্ছেদ করতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালিয়ে গেছে। ১৯৭৮ সালে তাদের ওপর নির্মম জাতিগত উৎখাত অভিযান চালানো শুরু হয়। এরপর ধাপে ধাপে তাদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের মাত্রা বেড়েছে। এর বিপরীতে রোহিঙ্গাদের স্বার্থরক্ষায় কিংবা এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের তা প্রতিরোধে সক্রিয় পরিকল্পনা দেখা যায়নি।
বিগত সময়ে দেয়াল নির্মাণ করে রোহিঙ্গাশিবির আলাদা করে দেয়া ও ভাসানচরে স্থানান্তরে সরকার যতটুকু আগ্রহ দেখিয়েছে সে তুলনায় তাদের নিরাপদে রাখাইনে ফেরাতে উদ্যোগ দেখা যায়নি। সঙ্কটের উৎসে এর সমাধান থাকলেও তা জোরালো গুরুত্ব পায়নি। এখনো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমান সামরিক বাহিনী যতটা সক্রিয় তৎপরতা চালাচ্ছে সেই মাত্রায় তা ঠেকানোর জন্য পাল্টা তৎপরতা নেই। এ অবস্থায় রাষ্ট্রহীন হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের লাঞ্ছিত হয়ে বেঁচে থাকা, আর বাংলাদেশের এর ভার বয়ে চলাই নিয়তি হয়ে থাকছে।
মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ নৃশংস অভিযান শুরু করেছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এর পরের পাঁচ মাস সব ধরনের আইন-কানুন লঙ্ঘন করে তাদের চালানো নির্মম উৎখাত অভিযানে সাত লাখ মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। আগে থেকে আরো চার লাখ রোহিঙ্গা ছিল। সব মিলিয়ে এখন ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এ দেশে। বিগত পাঁচ বছরে তাদের প্রত্যাবাসনের কাজ স্থবির হয়ে আছে। সর্বশেষ, জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশন-প্রধান টেকনাফ রোহিঙ্গাশিবির পরিদর্শন করে জানালেন, তাদের আরো ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে- রোহিঙ্গা উৎখাত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সেভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন দেশ তাদের কিছুটা মানবিক সহায়তা দিয়েছে মাত্র। তা-ও নতুন বিশ্ববাস্তবতায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি আর অগ্রাধিকার তালিকায় নেই।


রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা লক্ষ করেছি বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো তাদের মানবাধিকারের ব্যাপারে কোনো ধরনের অঙ্গীকার বা দায়বোধ করেনি। তাই রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারও কোনো চাপ অনুভব করে না। ফলে তারা অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করেনি। নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভিটেমাটি ফিরিয়ে দেয়া ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়টি নিয়ে রাখাইনে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ দিকে নির্যাতনকারীদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করার বিষয়ে কিছুটা অগ্রগতি হলেও ক্ষমতায় থাকা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ওপর তার কোনো প্রভাব নেই। বাংলাদেশের তৈরি করা আট লাখ ৪৩ হাজার রোহিঙ্গার তালিকার মাত্র ৪২ হাজার জনকে তারা দেশের নাগরিক বলে স্বীকার করেছে।
চীনের মধ্যস্থতায় তাদের দেশে ফেরার আলোচনাকে বারবার মিয়ানমার প্রতারিত করেছে। কয়েক দফা আলোচনায় পর দেয়া অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার জন্য তাদের কোনো মূল্য দিতে হয়নি। চীনের বন্ধুত্বও মিয়ানমারের সাথে অটুট রয়েছে। এ দিকে দেশটির সামরিক বাহিনী গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে ক্ষমতা নিয়েছে। এরপর দেখা গেল পরাশক্তি রাশিয়া তাদের সমর্থন ও শক্তি জোগাচ্ছে। ভারতের সাথেও তাদের বন্ধুত্বের স¤পর্কে কোনো হেরফের হয়নি। ভারতে থাকা রোহিঙ্গাদের ন্যূনতম মানবিক অধিকারও দেশটির সরকার দিতে চায়নি। বিশ্বশক্তিগুলোর এমন অন্যায় নীতি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার পাওয়ার অধিকারকে চিরতরে বঞ্চিত করবে বলেই আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারা নিজেদের কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না। পড়াশোনার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, কোনো ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই, শুধু ত্রাণ পেয়ে একটি জাতি এভাবে বেঁচে থাকতে পারে না। তারই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে- গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা অপরাধে মামলা হয়েছে দুই হাজার ৩৬৩টি। গ্রেফতার হয়েছেন চার হাজার ৯৭৯ জন। এ ছাড়া চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনাও ঘটছে। তাদের নিজেদের মধ্যে দলাদলিতে মারা যাচ্ছে অনেকে। এভাবে কোনো ধরনের আশা-ভরসাহীন রোহিঙ্গারা ভবিষ্যতে আরো বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে।
রোহিঙ্গা প্রশ্নে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশটির নাম বাংলাদেশ। বরাবরই মনে হয়েছে- দেশটি তার ক্ষতির বিষয়টি বিশ্ব সম্প্রদায়কে বড় করে দেখাতে পারেনি। তাদের জন্য শিবির স্থাপন, ভাসানচরে তাদের স্থানান্তর- এগুলোতে যতটা আগ্রহ সরকারের, ততটা আগ্রহ মানবাধিকার নিয়ে দেখাতে পারেনি। বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সহায়তায় এর সমাধানে জোরালো উদ্যোগ দেখা যায়নি। বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা সঙ্কটের বিষয়টি আমাদের কূটনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে ওঠেনি। সরকারের এ দুর্বলতা অবশ্যই কাটিয়ে উঠতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement