যথাযথ তদারকির অভাব

সারা পৃথিবীতে ট্রেন নিরাপদ বাহন হিসেবে বিবেচিত; কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ রেলক্রসিং অরক্ষিত থাকায় রেলপথ পুরোপুরি নিরাপদ নয়। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া রেলস্টেশনের কাছে একটি লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হন মাইক্রোবাসের ১১ আরোহী। গণমাধ্যমে প্রকাশ, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটে সেখানে কোনো গেটম্যান ছিলেন না। সড়কে রেলক্রসিংয়ে ছিল না সঙ্কেত। প্রতিবন্ধক দণ্ড না ফেলায় কোনো ধরনের বাধা ছাড়া রেললাইনের উপর উঠে পড়ে মাইক্রোবাসটি।
পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে ৮২ শতাংশ রেলক্রসিং অরক্ষিত। অর্থাৎ ট্রেন চলাচলের সময় যানবাহন আটকানোয় কোনো পাহারাদার কিংবা প্রতিবন্ধক, কিছু নেই। বাকি ১৮ শতাংশ ক্রসিংয়ে পাহারাদার ও প্রতিবন্ধক, দু’টি-ই আছে। কিন্তু পাহারাদারের অবহেলায় কিংবা চালকের অসতর্কতায় সেগুলোতেও দুর্ঘটনা ঘটছে। রেলের হিসাবে, ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রেলে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় ২২১ জন। এর মধ্যে ১৮৭ জন প্রাণ হারান রেলক্রসিংয়ে। অর্থাৎ রেলক্রসিংয়ে প্রাণহানি ৮৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। অবশ্য, রেললাইনে কাটা পড়ে মৃত্যুর হিসাব রেল কর্তৃপক্ষ রাখে না। মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুতি, এক ট্রেনকে অন্য ট্রেনের ধাক্কা, রেলক্রসিংয়ে গাড়িকে ট্রেনের চাপা, এগুলো দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, সারা দেশে মোট রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা দ্ইু হাজার ৫৬১। এগুলোর মধ্যে অনুমোদন নেই এক হাজার ৩২১টির। এসব ক্রসিংয়ের বেশির ভাগই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) সড়কে। আরো আছে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) সড়কে।
রেলওয়ের নথিপত্র অনুসারে, ২০১৫ সাল থেকে রেলক্রসিং নিরাপদ করতে ১৯৬ কোটি টাকা খরচ করেছে রেলওয়ে। দু’টি প্রকল্পের আওতায় রেলের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে ৭০২টি রেলক্রসিং উন্নয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় পাহারাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে এক হাজার ৫৩২ জন। রেলক্রসিং উন্নয়নের মধ্যে প্রতিবন্ধক বসানো ও পাহারাদারের জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এর পরও রেলক্রসিং নিরাপদ হয়নি। এ কথা ঠিক, পাহারাদারের চাকরি স্থায়ী নয়। প্রকল্পের অধীনে তাদের সর্বসাকুল্যে ১৪ হাজার টাকা বেতন দেয়া হয়। ২০১৫ সালের পর দু’টি প্রকল্পের অধীনে তাদের বেতন দেয়া হচ্ছে। প্রকল্প শেষ হলে বেতন থাকবে না; এ জন্য শুরুতে নিয়োগ পাওয়া অন্তত ৩০০ পাহারাদার চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। ফলে সব রেলক্রসিংয়ে পাহারাদার দেয়া যায় না। অস্থায়ী চাকরি বলে তাদের প্রশিক্ষণেরও খুব একটা ব্যবস্থা নেই।
সড়কে প্রাণহানির দায়ে শাস্তির সুনির্দিষ্ট আইন আছে; কিন্তু রেলক্রসিংয়ে প্রাণহানির দায়ে শাস্তির বিধান নেই। বরং যানবাহনের চালককে দায়ী করে রেল কর্তৃপক্ষ। বড়জোর পাহারাদারের ভুল পেলে তাকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু রেলে পাহারাদারের সঙ্কট থাকায় ক’দিন পরে আবার দায়িত্বে ফিরিয়ে আনা হয় বলে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে রেলওয়ে গতানুগতিকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করে। প্রায় সব প্রতিবেদনের ভাষা, সুপারিশ ও দায়ী করার পদ্ধতি একই রকম হয়ে থাকে বলে জানা গেছে।
যথাযথভাবে তদারকি না হওয়া এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহেলায় বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন; যা উদ্বেগজনক। এখানে যারা দায়িত্বশীল তিনি গেটম্যান হন, স্টেশনমাস্টার হন, সবারই কোনো না কোনোভাবে দায় আছে। রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও দায় নিতে হবে। এই দায় স্বীকার করে নিয়ে রেলক্রসিং নিরাপদ রাখতে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। পদক্ষেপগুলো হলো- রেললাইনের উপর দিয়ে যাওয়া সড়কে উড়ালপথ নির্মাণ করা। ট্রেন আসার সময় যানবাহন আটকে দিতে পথরোধক বসানো; ট্রেন এলে সময়মতো নামিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে পাহারাদার নিয়োগ করা। তাহলে সারা দেশের রেলক্রসিংগুলো নিরাপদ করা সম্ভব।