২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
গার্ডার ধসে পাঁচ প্রাণহানি

গাফিলতি অবহেলার বিচার নেই

-

বাংলাদেশে মানুষের প্রাণের মূল্য সবচেয়ে সস্তা। যেকোনো সময় যে কারো প্রাণ ঝরে যেতে পারে। মানুষের মৃত্যু একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও এ দেশে যেভাবে তাদের প্রাণ যাচ্ছে তাতে চরম উদাসীনতা ও গাফিলতি দেখা যাচ্ছে। একই অবহেলার কারণে হুবহু দুর্ঘটনা বারবার ঘটছে। রাজধানীর উত্তরায় বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পে গার্ডারের চাপায় পাঁচ প্রাণহানি তেমনি একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। আরো করুণ হলো, একটি জনাকীর্ণ সড়কে সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে সবার সামনে জীবন্ত থেঁতলে গেল মানবশরীর। যেখানে নিকটাত্মীয়রা তাদের স্বজনদের ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখেছেন। উদ্ধারে ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়ার সক্ষমতা দেখা যায়নি।
সোমবার বিকেলে পারিবারিক অনুষ্ঠান শেষে তারা ফিরছিলেন। উত্তরা সেক্টর-৩-এর প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় চলন্ত গাড়ির উপর গার্ডারটি পতিত হয়। খবরে জানা যাচ্ছে, গাড়িটির দুই-তৃতীয়াংশের উপর এটি আছড়ে পড়ে। এক পাশে থাকায় বেঁচে যায় গাড়িতে থাকা এক নবদম্পতি। চালক ও দুই শিশুসহ আরো দুই নারী গার্ডারের নিচে গাড়িসহ পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারান। পেছনে অন্য একটি প্রাইভেট কারে নিহতদের স্বজনরা ছিলেন। তারা দৌড়ে এসে দেখতে পান, ফাঁদে আটকা শরীর নিয়ে তারা তড়পাচ্ছে। দীর্ঘ সময় তারা এভাবে চোখের সামনে ভয়াবহ দুরবস্থা দেখলেও আর্তনাদ করা ছাড়া তাদের কিছুই করার ছিল না। গার্ডারের ওজন আনুমানিক ১২০ টন। পরিবারের লোকদের দাবিÑ সময়মতো উদ্ধার করা গেলে তারা বেঁচে যেতেন।
এ ঘটনায় বিআরটির প্রকল্পে ব্যবহৃত ক্রেনটি গার্ডারের ভার বহন করতে না পারায় দুর্ঘটনাটি ঘটে। ক্রেন কাত হয়ে গার্ডারটি চলন্ত গাড়ির উপর আছড়ে পড়ে। চলাচলকারী মানুষের জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটা গাফেল হলে একটি ব্যস্ত রাস্তায় এভাবে কাজ হতে পারে? এ ধরনের রাস্তায় মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল কাজ করা যেতে পারে। ব্যবহৃত ক্রেনের ক্ষমতা ও ত্রুটিহীন হওয়ার নিশ্চয়তা থাকার কথা। এমন গাফিলতি কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। এই প্রকল্পের কাজে এর আগেও দুর্ঘটনা ঘটেছে। ১৫ জুলাই গার্ডার চাপায় প্রকল্পের এক নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন। গত বছর একই ধরনের দুর্ঘটনায় ছয়জন প্রাণ হারান। চলতি বছরের মার্চে চট্টগ্রামে প্রায় একই ধরনের দুর্ঘটনায় এক পথচারী নিহত হন। সেখানেও ক্রেনের রশি ছিঁড়ে ধাতব পাত ছিটকে পড়ে ব্যস্ত রাস্তায়।

এ ঘটনার পর প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছেন অনেকে। নিঃসন্দেহে তাদের গাফিলতি অবহেলায় এটি হয়েছে। আমরা যদি বিচ্ছিন্নভাবে একে দেখি, তাহলে উন্নয়ন প্রকল্পকেন্দ্রিক মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি যে, একেবারে অবহেলা করা হয়েছে তার প্রতিকার পাবো না। এতগুলো মূল্যবান প্রাণের বিনিময়ে যাতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পায়, সেটি এখন সামনে আনা উচিত। আমরা যদি বিগত এক যুগে ঢাকাসহ সারা দেশে সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো লক্ষ করি, একই ধরনের অবহেলা-গাফিলতি দেখতে পাবো। ঢাকা শহরে পাতাল রেল, উড়াল সড়কসহ আরো যেসব উন্নয়ন প্রকল্প চলছে তাতে পথচারী সাধারণ মানুষের কথা মোটেও ভাবা হয়নি। প্রতিদিন এতে ভয়াবহ প্রাণহানি না হলেও মানুষকে ব্যাপক ভোগান্তির মধ্যে রাখা হয়েছে। সবার শীর্ষে থাকা সরকারি কর্তৃপক্ষ যদি সেটি আন্তরিকতার সাথে ভাবত, অনেক সীমিত দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেত।
নিহতের স্বজনরা এটিকে দুর্ঘটনা নয়; হত্যাকাণ্ড বলতে চান। তাদের মতে, এটি এমন এক প্রাণহানি যা এড়ানো যেত। প্রথমত, মানুষের নিরাপত্তার কথা না ভেবে ব্যস্ত রাস্তায় প্রকল্পের কাজ চালানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারা উদ্ধারকাজ সময়মতো করেনি। আমরা জানি না, এর কী জবাব রয়েছে কর্তৃপক্ষের কাছে। শহরকেন্দ্রিক যে উন্নয়ন প্রকল্প চালাচ্ছে সেগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিত। সবার আগে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে হবে। কমাতে হবে ভোগান্তি। আমরা আশা করব, সরকার উন্নয়ন নীতিতে পরিবর্তন আনবে যাতে সবার আগে মানুষের প্রাণের নিশ্চয়তা থাকে।


আরো সংবাদ



premium cement