২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
চবি ছাত্রলীগের অরাজকতা

ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ

-

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের পদ পাওয়া এক শ্রেণীর মধ্যে সোনার হরিণ পাওয়ার মতো। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটি-উপকমিটির পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি থেকে এ বিষয়ের প্রমাণ হয়। সরকারি দলের এই শাখা সংগঠনটির পদ পেলে সেখানে নগদ কিছু অর্জনের সুযোগ হওয়ার বিষয়টি নিজেদের দলের প্রতিপক্ষ ফাঁস করে দিচ্ছে। বিভিন্ন মর্যাদার পদবি ভিন্ন ভিন্ন অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বণ্টন হয়। নীতি আদর্শ কিংবা ছাত্রদের অধিকার আদায়ের কোনো ছাত্রসংগঠন এখন ছাত্রলীগ নয়। প্রত্যেকটি কমিটি ঘোষণার পর উপদলীয় কোন্দল থেকে সৃষ্ট সন্ত্রাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। সর্বশেষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে।
গত রোববার মধ্যরাতে কেন্দ্র থেকে চবি ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা হয়। তার কিছুক্ষণ আগে থেকে পদপ্রত্যাশীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও চট্টগ্রাম শহরে আগ্রাসী তৎপরতা শুরু করে। দফায় দফায় তারা চবির মূল ফটক অবরুদ্ধ করে রাখে। পরদিন সকালে শাটল ট্রেনের চালককে অপহরণ করে। তাদের মারমুখী অবরোধের মুখে শহর থেকে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বহনকারী কোনো গাড়ি চলেনি সোমবার। তাই কোনো ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। বিভিন্ন হলে হামলা চালিয়ে ৩০টি রুম ভাঙচুর করে। বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে তাদের তাণ্ডব দেখে মনে হয়- পদবঞ্চিতদের সংখ্যা তার চেয়ে ঢের বেশি, যারা মূলত একটি পদ পাওয়ার জন্য সংগঠনটি করে। পদ না পেলে সংগঠনটি করে তাদের আর ‘পোষাচ্ছে না।’ তাই ব্যাপক হাঙ্গামা চালিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রদের ক্ষতি করে হলেও তাদের পদ পেতে হবে। এ কমিটিতে ৩৭৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নবঘোষিত কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করার তিন বছর পর এবার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হলো। এ দু’জনের ব্যাপারে ছাত্রত্ব না থাকার অভিযোগ ছিল। একজন ১৬ বছর আগে, অন্য জন ১২ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন। নতুন কমিটির ব্যাপারে প্রাথমিক খোঁজখবরে জানা যাচ্ছে- ৩১টি গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন যাদের ছাত্রত্ব নেই। ১০ জন রয়েছেন যারা খুনসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। কয়েকদিন আগে গুরুতর অভিযোগে বহিষ্কৃত এক নেতাকেও যুগ্ম সম্পাদক পদ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া একটি বড়সংখ্যক পদাধিকারী যে চাকরিরত ও বিবাহিত তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, একটি ছাত্রসংগঠনের এ করুণ পরিণতি কেন? চবি ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ও এর সাম্প্রতিক ক্রিয়াকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে সে সম্পর্কে আমরা কিছুটা অনুমান করতে পারব। এখানে ছাত্রলীগ দু’টি ধারায় বিভক্ত। একপক্ষে রয়েছেন স্থানীয় এক উপমন্ত্রী, তিনি সাবেক এক মেয়রের সন্তান। অন্যপক্ষে রয়েছেন সাবেক আরেক মেয়র ও বর্তমান নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এ উপমন্ত্রীর আগেও এ ধারার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তার বাবা। দু’টি ধারার মধ্যে রয়েছে আরো বেশ কয়েকটি গ্রুপ। চট্টগ্রামের স্থানীয় লুটেরা রাজনীতির সাথে রয়েছে এর নিবিড় সম্পর্ক। এ অঞ্চলের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এ দু’গ্রুপের প্রাধান্য বিস্তারের লড়াই শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট, খুন, যখম, সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। কিছু দিন আগে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্রের খুলি উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অপরাধীদের পেছনে নেতারা ছায়া দেন, তাই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কোনো ধরনের বিচার করা যায় না। একই পরিবেশ এখন সারা দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে বিরাজিত। এর মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ ছাত্রদের।
ছাত্র নামধারী একটি শ্রেণী ছাত্রলীগ করে নিজেদের নগদ ফায়দা লুটে নিতে চায়। তারা ক্যাম্পাস ও তার আশপাশে চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি নিয়ে আগ্রহী। পদ বাগিয়ে নিতে পারলে নগদ পাওনাও বেশি হওয়ার সুযোগ থাকে। আরেকটি শ্রেণী রয়েছে যারা এদের ব্যবহার করে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে চায়; ছাত্রদের স্রেফ তাদের পেশিশক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। অন্য দিকে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের নীতিনির্ধারকরাও এ ব্যাপারে নির্লিপ্ত। তারা মাঝে মধ্যে ছাত্রদের হাতে বই খাতা কলম তুলে দেয়ার কথা বলেন, বাস্তবে তা আর হয় না। ক্ষমতাসীন দলকেই তাদের ছাত্রসংগঠনটির সৃষ্ট ধারাবাহিক অস্বস্তিকর পদবাণিজ্যের কর্মকাণ্ড নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement