২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
আইসিজেতে মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সিদ্ধান্তটি তাৎপর্যপূর্ণ

-

মিয়ানমারের রাখাইনে নিপীড়নের শিকার হয়ে ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, জাতিসঙ্ঘ যাকে ‘গণহত্যার অভিপ্রায়’ বলে অভিহিত করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা সংঘটনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে গাম্বিয়া। মামলার ওপর ওই বছরের ১০-১২ ডিসেম্বর শুনানি হয়। এতে মিয়ানমারের পক্ষে অংশ নেন দেশটির তৎকালীন স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। ওই মামলায় মিয়ানমারের আপত্তি আইসিজে খারিজ করে দিয়েছেন। এতে রোহিঙ্গা গণহত্যার মূল মামলার শুনানির পথ উন্মোচিত হলো। গত শুক্রবার নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে আইসিজে ওই রায় দেন। এর আগে মামলার প্রাথমিক শুনানির পর আইসিজে গাম্বিয়ার দাবিগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী মনে করে রাখাইনে গণহত্যা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমারকে নির্দেশ দেন।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলায় একটি স্মারক দাখিল করে গাম্বিয়া। সেখানে দেখানো হয়, কিভাবে তৎকালীন মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে। মামলার দ্বিতীয় দফা শুনানি শুরু হয় গত ২১ ফেব্রুয়ারি। তখন মামলা পরিচালনায় আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে মিয়ানমারের দায়ের করা আবেদনের ওপর শুনানি হয়। শুনানিতে অংশ নিয়ে মিয়ানমারের আইনজীবী বলেন, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়া চলছে। গণহত্যার অভিযোগের বিষয়টিও যথেষ্ট তথ্যনির্ভর নয়। বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে শুনানির বাস্তবতা নেই। অন্য দিকে, গাম্বিয়ার পক্ষের আইনজীবী বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে কোনো অগ্রগতি নেই। ২০১৭ সালে গণহত্যার কারণে রাখাইনে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি হয়েছিল, এখনো তা বিদ্যমান। মিয়ানমার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনে রাজি নন। মূলত গণহত্যার বিচার না হলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। ফলে এ আদালতে গণহত্যার বিচার অপরিহার্য এবং আদালতের সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী পূর্ণ এখতিয়ার আছে। এই শুনানির ভিত্তিতে শুক্রবার মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ করে আইসিজে সিদ্ধান্ত দেন, ১৯৪৮ সালের আন্তর্জাতিক জেনোসাইড কনভেনশনে সই করা সব দেশের দায়িত্ব গণহত্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখা। সেসব দেশ যখন কোথাও গণহত্যার অভিযোগ করে, তার ওপর শুনানির এখতিয়ার এই আদালতের রয়েছে।
এর ফলে রোহিঙ্গা সঙ্কটের দায় এড়াতে মুখরক্ষার মতো অজুহাত আর থাকল না মিয়ানমারের কাছে। বাস্তবে রোহিঙ্গা সঙ্কটে মিয়ানমারের দায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ত্রিবিধ। প্রথমত, রোহিঙ্গাদের শুধু সংখ্যালঘু হিসেবে চাপের মুখে নয়, ১৯৮২ সালের সংবিধানে তাদের নাগরিকত্ব খারিজ করে রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়। দ্বিতীয়ত, নানা বাহানায় দফায় দফায় নির্যাতন ও নিপীড়ন চালানো হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে কিংবা উগ্রবাদী সংখ্যাগুরুদের দিয়ে রোহিঙ্গাদের হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ভিটেমাটি ছাড়া করা হয়। তৃতীয়ত, যখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ও প্রত্যাবাসনের কথা ওঠে, দেশটি প্রতিবারই টালবাহানা করেছে।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে শুধু নয়, মিয়ানমারের সাথে সঙ্ঘাত এড়িয়ে এ সঙ্কট সমাধানে সর্বোচ্চ সদিচ্ছার পরিচয় দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার ওই সদিচ্ছার সামান্যতম মূল্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। এর নেপথ্যে ছিল মূলত চীন। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন শুরুর কথা ছিল। কিন্তু সে প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়নি মিয়ানমারের অনাগ্রহে। এ অনাগ্রহের কারণ- এ অঞ্চলে চীন ও ভারত বাংলাদেশের ‘বন্ধু’ এবং পরস্পরের ‘বৈরী’ হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশ দু’টির অবস্থান এক। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের অন্যায্য অবস্থান যখন গোটা দুনিয়ার কাছে স্পষ্ট, তখন বেইজিং বা দিল্লিø কার্যত নেপিদোর পাশে দাঁড়ায়। একটি জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার দায় ভারত ও চীন পরোক্ষভাবে এগিয়ে যায় যা ছিল দুঃখজনক।
এটি সত্য, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান সরলরৈখিক নয়। তবু মিয়ানমারের আবেদন আইসিজে-তে খারিজ হওয়ায় রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশের ভূমিকা আগের তুলনায় আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বর্তমান এ পরিস্থিতিকে যদি কোনো পরিণতির দিকে নিতে হয়, তাহলে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমার চাপে পড়ে। তবে মনে রাখতে হবে, বাস্তবে নয়াদিল্লøী বা বেইজিং রোহিঙ্গা ইস্যুতে শেষ পর্যন্ত ভূরাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে মিয়ানমারের পাশে থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারে। এটি ধরে নিয়েই ঢাকাকে কূটনৈতিক পরিকল্পনা সাজাতে হবে।

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement