২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
ইলিশ হতে পারে অর্থনীতির বড় খাত

দরকার দূষণমুক্ত পরিবেশ

-

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। অত্যন্ত সুস্বাদু এ মাছ বাঙালির পছন্দের তালিকায় আছে সবার আগে। এটি যুগ যুগ ধরে দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা যেমন মেটাচ্ছে তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলিশ আহরণের সাথে সরাসরি নিয়োজিত ছয় লাখ জেলে। বিপণন, রফতানিসহ নানাভাবে আরো বিপুলসংখ্যক মানুষ ইলিশের ওপর নির্ভরশীল। বলতে গেলে ইলিশ আমাদের এক জাতীয় সম্পদ। বিশ্বে উৎপন্ন মোট ইলিশের ৮০ শতাংশই হয় বাংলাদেশে। আর ১৫ শতাংশ হয় ভারতে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে; যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১২ শতাংশ। এর চলতি বাজারমূল্য ২১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ভারতে ২০০২-২০১৮ সালে ইলিশের জোগান যেখানে ৫৬ শতাংশ কমে যায়, সেখানে বাংলাদেশে ১৬০ শতাংশ বেড়েছে। গত ১০ বছরের ব্যবধানে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। প্রতি বছর ইলিশ মাছ রফতানি করে ৩০০ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।
ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ রয়েছে। প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা ও জাটকা নিধন বন্ধ রাখা হয়। এ সময় জেলেদের বিশেষ সহায়তা দেয়া হচ্ছে নিয়মিত। এতে করে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু তা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে হচ্ছে না। নদীদূষণ ও নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন এ ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা।
নদীদূষণ ও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে হুমকিতে পড়েছে ইলিশের অন্যতম প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র মেঘনা। নদীতে চলাচল করা লঞ্চ, জাহাজসহ অন্যান্য নৌযানের পোড়া তেল, মবিল এবং শিল্পকারখানার বর্জ্যে দূষণের শিকার হচ্ছে মেঘনা। এমনকি বুড়িগঙ্গার দূষিত নোংরা পানিও ছড়িয়ে পড়ছে মেঘনায়। অন্য দিকে অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং বা খনন করে বালু উত্তোলনে মেঘনার দূষণ ভয়াবহ রূপ নেয়। সব মিলিয়ে দূষণ ও ড্রেজিংয়ে মেঘনা নদীর ইলিশ প্রজনন ও বিচরণ সাম্প্রতিক সময়ে মারাত্মকভাবে কমেছে বলে খোদ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) গবেষণায় বলা হয়েছে। সম্প্রতি মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলন বন্ধ করা হয়েছে; কিন্তু বালুমহালের সাথে জড়িত প্রভাবশালীরা এতে ক্ষুব্ধ। কারণ মেঘনার বালুমহাল থেকে মাসে ২৫-৩০ কোটি টাকার বালু উত্তোলন করে তারা। এর সাথে একটি প্রভাবশালী রাজনীতিক মহলও জড়িত। এত বড় একটি ব্যবসায় হাতছাড়া হবে তা মানতে পারছে না তারা। এ জন্য তারা আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছে। শুরু হয়েছে সরকারি পর্যায়ে তদবির। বালু উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া সরকারি কর্মকর্তাকে তাদের চাপেই বদলি করে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগও উঠেছে। এ নিয়ে রোববার নয়া দিগন্তসহ একাধিক জাতীয় দৈনিকে রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে।
নদীদূষণে যে শুধু মেঘনা নদীতেই ইলিশের চিরণক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে তা-ই নয়, দেশের অন্যান্য নদীগুলোতেও ইলিশের বিচরণ ও প্রজনন কেন্দ্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দূষণে ইলিশের স্বাদ-গন্ধও পাল্টে যাচ্ছে। একটি গবেষণায় জানা গেছে, সম্প্রতি মেঘনার ইলিশের পেটে ৩৬ শতাংশ বালু এবং কাদা পাওয়া গেছে। পানিতে বালু ও কাদার পরিমাণ বাড়ছে বালুমহালের কারণেই। সেসব ভাসমান বালু ও কাদা ইলিশের পেটে চলে যাচ্ছে এবং তা হজম হচ্ছে না। লঞ্চ, কার্গো, স্টিমার চলছে, এগুলোর বর্জ্য পানিতে পড়ে পানি নষ্ট হচ্ছে। মাছের খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণেই ইলিশের সেই ব্যতিক্রমী স্বাদ-গন্ধ কমে গেছে।
গবেষকদের মতো আমরাও মনে করি, ইলিশের বিচরণক্ষেত্র ও প্রজনন কেন্দ্রগুলোয় দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা হলে বছরে সাত হাজার কোটি টাকা মূল্যের ইলিশের বাজার সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। এর ফলে অর্থের প্রবাহই শুধু বাড়বে না, বাড়বে কর্মসংস্থানও। এভাবে ইলিশ হয়ে উঠতে পারে দেশের অর্থনীতির এক বড় খাত। আমরা আশা করব, বিষয়টি এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনায় নিয়ে যা কিছু করণীয় তা করতে এগিয়ে আসবে সরকার।


আরো সংবাদ



premium cement