২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
আইনশৃঙ্খলার টানা অবনতি

কেউ দায় নিচ্ছে না

-

বাড়ির আঙিনায় শুভ্রা রানী দাস কাঁদতে কাঁদতে চেতনা হারিয়েছেন। বাড়ির সামনে বসে আহাজারি করছেন তার স্বামী মাধব চন্দ্র। তাদের স্কুলপড়–য়া সন্তান ধ্রুবের লাশ এসেছে অ্যাম্বুলেন্সে করে। গত মঙ্গলবার রাতে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে তার স্কুলের সামনে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে ধ্রুবকে। সন্দেহভাজন খুনিদের মধ্যে পাঁচজন তার স্কুলের শিক্ষার্থী। আরেকটি ঘটনায়, ফরিদপুরের সদরপুরে বাড়িতে ঢুকে কুপিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানের শিশুপুত্রকে হত্যা করা হয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মম এ হত্যাকাণ্ডে বাধা দিতে গিয়ে তার মা গুরুতর আহত হয়েছেন। এ ধরনের নারকীয় খুন ছাড়াও চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, দস্যুতা, ধর্ষণ, শিশু নির্যাতনসহ বেআইনি কর্মকাণ্ড বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে ক্রমবর্ধমান। এসব নিয়ে নাগরিক পর্যায়ে জোরালো আলোচনা নেই, এটিকে আইনশৃঙ্খলার গুরুতর অবনতি হিসেবে শনাক্ত করে এর জন্য কাউকে দায় নেয়ারও গরজ দেখা যাচ্ছে না।
নারায়ণগঞ্জের ধ্রুব হত্যায় গ্রেফতার হওয়া সবাই কিশোর। সংবাদের বিবরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে, উঠতি বয়সী তরুণরা নিজেদের মধ্যে কোনো ধরনের বিরোধের জন্য তাকে হত্যা করেছে। কিশোর গ্যাং সারা দেশে খুনখারাবি অসামাজিক কার্যকলাপসহ আরো বহুবিধ অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। সব জায়গায় তাদের প্রায় একই চরিত্র। পাড়ায় মহল্লায় ফুটপাথে জমিয়ে তাদের আড্ডা দিতে দেখা যাচ্ছে। এদের পোশাকি চরিত্রটি হলো টি-শার্ট, জিন্স প্যান্ট, চোখে সানগ্লাস, অভিনব সব হেয়ার কাট, সিগারেট ধরানোর জন্য দামি লাইটার, উচ্চৈঃস্বরে গান করে আর রাস্তায় চলাচলকারী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। এদের রয়েছে বিভিন্ন নামের গ্রুপ। প্রতিনিয়ত সারা দেশ থেকে এ গ্রুপের অপরাধ কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়; কিন্তু তাদের বিচারের আওতায় আনা কিংবা সংশোধনের উদ্যোগ দেখা যায় না। কিশোর গ্যাংয়ের বিপজ্জনক কর্মকাণ্ড রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয় পায়। খুন করার মতো নিষ্ঠুরতা বন্ধ করতে হলে এদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা।
ফরিদপুরে ইউপি চেয়ারম্যানের বাসায় ঢুকে শিশুপুত্র খুন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা অংশ। এ ধরনের অপরাধ সভ্য সমাজের জন্য গুরুতর একটা ব্যাপার হলেও আমাদের সমাজে এমন খুনোখুনি গা সওয়া হয়ে গেছে। এ ধরনের খুনের ঘটনা এত বেশি হারে ঘটে চলেছে যে, সংবাদ হিসেবেও গুরুত্ব হারাচ্ছে। অথচ এমন একটি ঘটনা ঘটার সাথে সাথে প্রশাসনের জোরালো পদক্ষেপ হতে পারত। ঘটনার পর দেখা যায়, খুনিপক্ষও শক্তিশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে। এ অবস্থায় বেশির ভাগ জঘন্য খুনের ঘটনারও বিচার আর এগোয় না। এ ছাড়া অন্য সব অপরাধের সূচকও ঊর্ধ্বমুখী। পুলিশের প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে এ চিত্র পাওয়া যায়। ২০২০ সালে দেশে ছয় হাজার ৫৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। আগের বছরের চেয়ে এটি প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ বেড়েছে। চুরি-ডাকাতি ছিনতাই- এ ধরনের প্রত্যেকটি অপরাধের পরিসংখ্যানে বিগত বছরগুলোতে ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষ নানাভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে আরো বেশি খুন সন্ত্রাস ছিনতাই অনিয়মের শিকার হচ্ছে। একসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে সাংবাদিকদের একটি প্রশ্ন থাকত। সাধারণত কোনো অপরাধ সংঘটিত হলেই তারা সেটি উল্লেখ করে প্রশ্ন করতেন, ‘আপনি কি মনে করেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক বা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে?’ অবশ্য ওই সময়ে মানুষ বর্তমান সময়কার মতো এতটা অনিরাপদ হয়ে যায়নি। তারপরও এ প্রশ্ন শুনে ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা বিব্রত হতেন কিংবা একটা দায়বোধ অন্তত দেখাতেন পরিস্থিতি উন্নত করার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইনশৃঙ্খলার গুরুতর অবনতির মধ্যেও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এ ধরনের প্রশ্ন করার রেওয়াজও উঠে গেছে। সাংবাদিক সমাজ, সুশীল সমাজও যেন নতুন পরিস্থিতিতে খেই হারিয়ে ফেলেছে। রাষ্ট্র সরকার সবাই যেন ক্রমেই নির্বিকার হয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমনটি কোনোভাবে দীর্ঘ দিন চলতে পারে না। আমরা মনে করি, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য দায়িত্বশীলদের জবাবদিহিতা থাকা উচিত।

 


আরো সংবাদ



premium cement