বসন্তের অগ্রদূত চেরি
- জয়নুল আবেদীন
- ০৯ মে ২০২২, ০০:০০
গ্রীষ্মমণ্ডলের বসন্তবরণের সাথে হিমমণ্ডলের বসন্তবরণে বেশ পার্থক্য রয়েছে। হিমমণ্ডলের প্রকৃতিই জানিয়ে দেয় বসন্তের আগমন বার্তা। উজ্জীবিত প্রকৃতির সাথে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে মানুষ। মহাসমারোহে পালন করা হয় বসন্ত। গ্রীষ্মমণ্ডলে শীত-গ্রীষ্মের মাঝে বসন্ত কখন আসে কখন যায়, কেউ টের পায় কেউ পায় না। আমাদের যাপিত জীবনে বসন্তের প্রতি হেলাফেলা ও বিড়ম্বনা দেখেই কবিগুরু বলেছেনÑ
‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে।’
লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে সর্পিল গতিতে কয়েকপাক ঘুরেই সোজা রাস্তা লন্ডন সিটির দিকে। রাস্তার দুই পাশে বন-বনানী ও ফসলের সবুজ মাঠ। ছোট ছোট গাছের মাথায় নানা রঙের কোমল মেঘের পাগড়ি। ডালপালা ঢেকে রাখা পেঁজা তুলা কিংবা মেঘের পাগড়ি দেখে মনে পড়েছিল সেই শৈশবের হাওয়াই মিঠাইর কথা। গাঁয়ের মেঠোপথে হেঁটে হেঁটে ফেরিওয়ালার সেই শিশু ভোলানো ‘সুস্বাদু হাওয়াই মিঠাই’। মাকড়সার সুতার মতো, যা হাত লাগলেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এর আগেও কয়েকবার লন্ডন এসেছিলাম; এই দৃশ্য চোখে পড়েনি। চোখে পড়তেই ইচ্ছে করছিল মেঘের পাগড়ি ছুঁয়ে দেখি, মন খুলে ভালোবাসি। আমার ইচ্ছের কথা প্রকাশ করতেই,
Ñআব্বা, চেরি ফুল। সবাই বলে চেরি ব্লসোম। সারা লন্ডনজুড়েই এই ফুল। এখানে শীতের শুরুতেই গাছের পাতা ঝরে যায়। ডালপালা নিয়ে মড়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকে গাছগুলো। কোনো কোনো মড়া গাছের ডালপালায় শ্যাওলা-ফাঙাস লেগে থাকে। দেখলে মনে হয়, রান্নার খড়ি ছাড়া আর কোনো কাজেই লাগবে না। শীতের তীব্রতা কমতে শুরু করতেই প্রাণ ফিরতে শুরু করে প্রকৃতির। চেরিগাছে পাতার কুঁড়ি বের হওয়ার আগে বের হয় কোমল ফুলের মুকুল। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ফুলে ফুলে ঢেকে যায় গাছের ডালপালা। বসন্তের শুরুতেই এই ফুল ফুটতে শুরু করে। তাই, চেরি ফুলকে বলা হয় বসন্তের অগ্রদূত। এ দেশে প্রত্যেক বাড়িতেই চেরিগাছ আছে। আমাদের ঘরের পেছনেও আছে চেরিগাছ।
Ñকই একবারো চোখে পড়েনি?
Ñকী করে চোখে পড়বে? প্রতিবারই ডিসেম্বরে আসেন। ডিসেম্বর মাস মরা মাস। গাছপালাসহ প্রকৃতি হয়ে পড়ে মড়ার মতো মুমূর্ষু। আমাদের চেরিগাছেও ফুল ফুটতে শুরু করেছে। আমাদের গাছের ফুল সাদা। দেখতে ঠিক বাংলাদেশের বউন্না ফুলের মতো। গাছের ডালপালাও সে রকম। পার্থক্য, বউন্নাগাছে ফুল ও পাতা একসাথে হয় আর চেরিগাছে প্রথমে শুধু ফুল হয়। বউন্না ফল কদাকার ও অকেজো। চেরিগাছে ফুল ঝরতে শুরু করলেই বের হতে শুরু করে পাতার কুঁড়ি ও চেরি ফলের কড়া (মুকুল)। টুকটুকে লালসহ নানা রঙের চেরি ফল, খেতেও সুস্বাদু। আমাদের বাড়ির পাশেই পার্ক। পার্কে রয়েছে সারি সারি চেরিগাছ।
পরদিন ঘুম ভাঙতেই মনে পড়ে চেরি ফুলের কথা। বাসা থেকে পার্ক পাঁচ মিনিটের পথ। দূর থেকেই চোখে পড়ে নানা আকারের গাছ ও নানা রঙের ফুল। কোনো কোনো গাছের ফুল ফুটতে শুরু করেছে, আবার কোনো কোনো গাছের ফুল ঝরে পড়ছে। একই ফুলে এত রঙ ও এত রকম কেন?
Ñরকম ও রঙ ভেদে কয়েক শ’ প্রকারের চেরিগাছ রয়েছে। তবে যে প্রকারের চেরিই হোকÑ এই সময় অর্থাৎ শীতের শেষে ফুটতে শুরু করে। শুরু থেকে অল্পদিনের মধ্যেই ঝরে পড়তে শুরু করে ফুলগুলো।
লন্ডনে চেরির পরই যে ফুলটি আমার নজর কেড়েছে সে ফুলটির নাম সরষে ফুল। আমাদের চির পরিচিত সরষে ফুল। সরষে ফুল নজর কেড়েছিল শেক্সপিয়ারের বাড়ি আসা-যাওয়ার পথে। লন্ডনের চ্যাডউইলহিত থেকে স্ট্র্যার্টফোর্ড আপন অ্যাভন শেক্সপিয়ারের বাড়ি। দীর্ঘ পথ। ট্যাক্সি করে আসা-যাওয়া পাঁচ ঘণ্টার পথ। পথের দু’পাশে হলুদ মাঠ দেখেই মনে পড়ে দেশের কথা। শীতকালে বাংলার সরষেক্ষেত আর লন্ডনের বসন্তকালের সরষেক্ষেতে অভিন্ন রঙ ও সৌন্দর্য। লন্ডনে মাঠের পর মাঠ হলুদ সরষে ফুল ঠিক যেন বাংলাদেশের শীতকালের মাঠ। গাড়ি থামানোর সুযোগ না থাকায় চলন্ত গাড়ি থেকেই সরষেক্ষেতের ভিডিও করতাম।
হেনার বাসার পেছনে যে চেরিগাছ সে গাছটি এপ্রিলের ১১ তারিখেও নজরে আসেনি। সুইডেন আসার আগের দিন অর্থাাৎ ১৬ এপ্রিল চোখে পড়েছিল। ঠিক যেন ফুলে ফুলে ছাওয়া পাতাবিহীন বউন্নাগাছ। ছবি তুলব তুলব করেও তোলা হয়নি। ১৭ এপ্রিল চলে আসি সুইডেন। ২৪ এপ্রিল ফোন করে জানতে পারি, গাছটিতে ফুল ঝরতে শুরু করেছে।
সুইডেন আসার পরদিন যাই লিনিয়াস বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে। লাইব্রেরি দেখা শেষ করে বের হয়ে সামনেই বন। বন মানে, জঙ্গল নয়। পাইন-জাতীয় হাজার হাজার লম্বা গাছ। বনের মাঝে পাথরের বানানো টিলা। টিলার চার পাশে পায়ে চলা পথ। পথের পাশে ঝরে পড়া শুকনো পাতার স্তূপ। মচমচে শুকনো পাতার স্তূপ ভেদ করে বের হচ্ছে হলুদ ফুল। তা দেখে মল্লিকা,
Ñআব্বা দেখেন, কিভাবে মাটি ভেদ করে ফুল বের হচ্ছে!
Ñবাহ কাগজের ফুলের মতো। ফুলটির নাম?
Ñএ সময় সারা সুইডেনের বন-জঙ্গল, মাঠঘাট সর্বত্রই এরকম ফুল দেখতে পাবেন। এ রকম ফুল ফুটতে শুরু করলেই বুঝতে পারি, শীত শেষ। বসন্ত শুরু। এই ফুলটির নাম ড্যাফোডিল। নানা রঙের ড্যাফোডিলের মধ্যে সাদা পাপড়ির, হলুদ বৃন্তের ফুলই বেশি দেখা যায়।
Ñড্যাফোডিল নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন William Wordsworth.
কবিতারÑ
Beside the Lake, beneath the trees, Fluttering and dancing in the breeze.
দু’টি লাইন এখনো মনে আছে। কবিতাটি এতই জনপ্রিয় ছিল যে, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অনেক সংস্থার নামও ড্যাফোডিল।
Ñঅসংখ্য কবিতা, গল্প ও ছড়া রয়েছে চেরি ফুল নিয়েও। যেমনÑ While in the sunshine White in the rain leaning out from the wall at the top of the lane’
সুইডেনে লোক বসতি কম। বাড়িঘরও কম। এখানে ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যে কয়েকটা বাড়ি আছে সে কয়েকটা বাড়িতে রয়েছে আপেলসহ নানা রকমের ফুলের গাছ। আমি যেখানে বসে লেখালেখি করি সেখানে বসে বাইরের দিকে তাকালেই নজর কাড়ে ছোট্ট একটি চেরিগাছ। একদিন মল্লিকা ও আনিকাকে নিয়ে বের হয়ে পড়ি সুইডেনের চেরিসহ বসন্ত দেখার জন্য। বসন্ত ভয় পায় শীতকে। ইংল্যান্ড থেকে সুইডেনে শীত বেশি। বসন্ত শুরু হয় পরে। লন্ডনের মধ্য বসন্তে সুইডেনে শীত বিদায় নিতে শুরু করে। মাঠ, মাটি ও গাছের ডালপালা কাণ্ড ফেটে বের হতে শুরু করে কলি ও ফুল। বসন্তের দূত হয়ে সবার আগে ফোটে চেরি। পরিমিত পরিমাণ ভূখণ্ডের উপর ছোট ছোট বাড়ি। চার দিকে লতা-গুল্মের দেয়াল। দেয়ালের গোড়ায় গজিয়ে উঠতে শুরু করেছে ঘাস। ঘাসের মুখে হলুদ, নীল ও বেগুনি রঙের ফুল। শত শত একরজুড়ে বন। বনের তলায় মাটি ভেদ করে বের হচ্ছে নাম না জানা বাহারি রকমের ফুল।
সুইডেনের বসন্ত খুঁজতে গিয়ে অবহেলিত যে তৃণটি আমার কাছে আপন মনে হয়েছে সে তৃণটির নাম দূর্বা ঘাস। সুইডেনের মাঠভর্তি দূর্বা ঘাস। কাক-দোয়েলসহ অনেক কিছুতে ভিন্নতা থাকলেও দূর্বা অভিন্ন। মাঠ ভরা দূর্বা ঘাস দেখে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘সব কিছু সুইডেনের হলেও দূর্বা ঘাস আমাদের বাংলাদেশী’।
পথঘাট ও বনবাদাড়ের মাটি ভেদ করে বের হওয়া নানা বর্ণের ফুল কেউ রোপণ করেনিÑ পরিচর্যাও করে না কেউ। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে শীতের বিদায়ে এরা ফোটে আবার শীতের আগমনে মিলিয়ে যায়। এই নিয়ম চলছে অনন্তকাল থেকে। স্কুল-কলেজ, প্রতিষ্ঠান, শিশুদের ব্যায়ামাগার, সুপার শপ, খাবারের দোকান, গাড়ি গ্যারেজ যেখানে সুযোগ রয়েছে সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে রাহারি রঙের চেরিগাছ। লন্ডনের চেরিগাছের সাথে সুইডেনের চেরিগাছের পার্থক্য লক্ষণীয়, লন্ডনে যত বড় গাছ এবং বাহারি রঙের চেরি ফুল রয়েছে সুইডেনে তত নেই। চেরি উন্মাদনায় এগিয়ে রয়েছে জাপান। জাপানের জাতীয় ফুল চেরি। চেরি ফুল নিয়ে জাপানিদের প্রধান উৎসবের নাম ‘হানামি’। শীত শেষে এপ্রিলের শুরুর দিকেই শুরু হয় হানামি উৎসব। জনশূন্য পার্ক ভরে ওঠে জন কোলাহলে।
সুইডেন থেকে ডেনমার্ক হয়ে ফ্রান্স যাওয়ার কথা। ফ্রান্স থেকে মেজো মেয়ে টগর বারবার ফোন করছে। চেরি ব্লসোম বিষয়ে কথা হয় টগরের সাথে। টগরের দুই মেয়ের জন্ম ইউরোপে। গড়ে উঠছে ইউরোপের আদলে। চেরি সম্পর্কে জানতে চাইলেÑ
আব্বা, চেরি সম্পর্কে তেহজিব (বড় মেয়ে) ভালো জানে। আমাদের বাসার কাছেই মন্ট্রিও (Montreu) পার্ক। পার্কে ক’দিন আগেও চেরি ব্লসোম দেখেছি। এখন আছে কি নেই তেহজিব বলতে পারবে, (তেহজিবকে ফোন দিয়ে) নানুভাইয়ের সাথে কথা বলোÑ
Do you still have cherry Blossom in Paris?
No nanabhai, it is almost finished.
Why?
It was time for cherry blossom about a month ago. It’s all leaves now.
লিনিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে টেলিবরি ক্যাসল। টেলিবরি ক্যাসলে যাওয়ার পথে ছোট্ট একটি ব্যায়ামাগার। শিশুদের জন্য নির্মিত ব্যায়ামাগারের একপাশে বেশ কয়েকটি চেরিগাছ। গাছের ডালপালা ছেয়ে রয়েছে ফুলে। নীল আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা চেরিগাছগুলো ছবির মতো লাগছে। মন চাইছিল ছবির মতো কোমল ফুল স্পর্শ করি, কথা বলি। গাছের পাশে গিয়ে ফুলে ভরা একটি ডাল কাছে টেনে, ‘বসন্তের অগ্রদূত চেরি ব্লসোম, তুমি আমায় ভুলে গেলেও আমি তোমায় ভুলব না।’ হ
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা