২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা হয়েছে

এ স্বীকৃতি কাজে লাগাতে হবে

-

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহিংসতাকে ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী’ অপরাধ বলে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিগত উৎখাতে পরিচালিত ঘৃণ্য অপরাধটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর সাড়াদান অত্যন্ত ধীর বলে আমরা লক্ষ করেছি। জাতিসঙ্ঘসহ প্রভাবশালী পক্ষগুলো সময়মতো সাড়া দিলে রোহিঙ্গাদের দেশটি থেকে বিতাড়িত হতে হতো না। এমনকি এতদিনে রাখাইনে তাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়াও হয়তো সম্ভব হতো। বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তিসহ বেশ কিছু ঘটনায় গত দশকগুলোতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যেমন আমরা সাড়া দিতে দেখেছি, সময়মতো সেটি না হলেও যুক্তরাষ্ট্র্র এ ব্যাপারে তাদের মনোযোগ নতুন করে নিবিষ্ট করায় আশাবাদী হওয়ার কারণ রয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ প্রধানত দুটো, উৎখাত হওয়া রোহিঙ্গাগোষ্ঠী ও তাদের থাকার জায়গা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ। এর প্রতিকার পাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের কোনো শক্তি সামর্থ্য নেই। তাদের প্রতি আন্তর্জাতিক কোনো বন্ধু কিংবা সহমর্মী দেশ কিংবা সম্প্রদায়ও নেই; থাকলেও তার কার্যকারিতা সেভাবে দেখা যায়নি। অন্য দিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর করা একটি অন্যায়ের শিকার বাংলাদেশ। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হয়েও বাংলাদেশকে ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য বড় একটি এলাকা ছেড়ে দিতে হয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের সাথে বাংলাদেশের পার্থক্য হচ্ছে, বাংলাদেশের বহু প্রভাবশালী বন্ধু দেশ ও বৈশ্বিক পর্যায়ে নানা গোষ্ঠী সংগঠনের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। দেখা গেল এ ইস্যুতে রোহিঙ্গাদের মতোই বাংলাদেশ অসহায় কিংবা দেশটি এ ব্যাপারে প্রতিকার পেতে ততটা উদগ্রীব নয়। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের সব দলিল প্রমাণ থাকার পরও এর সমাধানে কোনো অগ্রগতি নেই।
মিয়ানমার সামরিক বাহিনী বেসামরিক নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের ওপর বড় বড় অপরাধ করেছে। তাদের ঘরবাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। শিশু ও নারীদের গণহারে ধর্ষণ করেছে। হাজার হাজার মানুষকে প্রকাশ্যে নৃশংস কায়দায় হত্যা করেছে। তাদের হামলায় রাখাইন প্রদেশ থেকে প্রায় সব রোহিঙ্গা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেছে। বাকি রোহিঙ্গাকে আটক করে রেখেছে বন্দিশিবিরে। সেখানে আরেক নারকীয় পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। তাদের কৃত প্রত্যেকটি অপরাধের দলিল প্রমাণ রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ হিসেবে সেগুলো নিয়ে বাংলাদেশের চালানো তৎপরতা অত্যন্ত দুর্বল। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করেন গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী। তিনি রোহিঙ্গা শিবির দর্শনে এসে তাদের করুণ দুরবস্থা দেখে বিবেকের তাড়নায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলাটি করেছেন। সেই মামলা এগিয়ে নেয়ার জন্য গাম্বিয়াকে কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতর তাদের সহযোগী হয়ে গাম্বিয়ার জন্য বিষয়টাকে সহজ করবে এমন জোরালো উদ্যোগের খবর পাওয়া যায় না।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চালানো অভিযানকে ‘গণহত্যা’ বলে ঘোষণা দিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের ওয়াশিংটন ডিসিতে হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে দেয়া বক্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘ইহুদিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হলোকাস্ট ছাড়াও বিশ্বে সাতটি গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। আজ অষ্টম গণহত্যার স্বীকৃতি দেয়া হলো।’ রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরা ও নাগরিক অধিকার রক্ষার কাজে আমেরিকার নীতিগত অবস্থানের পরিবর্তন আরো আগে থেকে অনুমান করা গিয়েছিল। গত বছর মালয়েশিয়া সফরের সময় ব্লিঙ্কেন জানিয়েছিলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নিপীড়ন গণহত্যা কি না, তা খুবই সক্রিয়ভাবে খতিয়ে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।
রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা ও অবস্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মূলত মিয়ানমারের করা অপরাধকে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার নৈতিক দায়িত্ব বাংলাদেশের। এ যাবৎ রোহিঙ্গাদের বিচার পাওয়ার যে প্রচেষ্টা, সেখানে বাংলাদেশের অবদান ততটা সক্রিয় অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে না। গাম্বিয়ার করা মামলাটি চালাতে যাতে মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসির পক্ষ থেকে জোরালো সমর্থন পাওয়া যায় সেই চেষ্টায়ও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সংগঠনটির পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থিত থাকছেন না। সেখানে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আলোচনার সুযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে জাতিসঙ্ঘ ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানকে ‘গণহত্যামূলক কাজ’ বলে অভিহিত করে। অথচ বিচার পাওয়ার জন্য এ ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ হওয়ার কথা বাংলাদেশের। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের ব্যাপারে কতটা আন্তরিক সেটি প্রমাণ করবে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক কতটা। আমরা দেশটির সাথে সহযোগিতামূলক অবস্থানে থেকে এ সঙ্কটের সমাধান করতে পারব না। আমাদের স্পষ্ট করে বলতে হবে, মিয়ানমার ‘গণহত্যা’ ও ভয়াবহ ‘জাতিগত নিধন’ চালিয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ‘গণহত্যা’ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র্রের এ স্বীকৃতির পর বাংলাদেশকেও গলা চড়া করতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement