২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
নিরাপদ করতে কার্যকর উদ্যোগ নেই

অরক্ষিত রেললাইনে প্রতিনিয়ত মৃত্যু

-

নিরাপদ গণপরিবহন হিসেবে ট্রেন স্বীকৃত। একই সাথে রেলভ্রমণ সাশ্রয়ীও বটে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দেশের রেল সড়কের ৮২ শতাংশই অরক্ষিত। পৃথিবীর কোনো আধুনিক ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মাটিতে রেখে রেলের তিন বা চার লাইনের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক করা হচ্ছে না। আমাদের দেশে তা হচ্ছে। ভূমির উপর দিয়ে রেললাইন হওয়ায় ট্রেন এলে যানবাহন কিংবা মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণে কেউ না থাকায় প্রায় প্রতিদিনই ট্রেনে কাটা পড়ে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সাথে অন্য যানবাহনের সংঘর্ষেও ঘটছে প্রাণহানি।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন গড়ে রেললাইন থেকে অন্তত দু’টি লাশ উদ্ধার করা হয়। মাসে গড়ে প্রাণ হারাচ্ছে ৬৪ জন। গত বুধবারও কুমিল্লøা সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুরে রেললাইন পার হওয়ার সময় ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারায় তিন স্কুলছাত্রী। লক্ষণীয় বিষয়Ñ রেললাইনে মৃত্যুর একটি বড় অংশের কারণ চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। ‘দুর্ঘটনা’ নাকি ‘হত্যা’ করে লাশ রেললাইনে ফেলে রাখা হচ্ছে এটি স্পষ্ট না হওয়ায় অপরাধীরাও পার পেয়ে যাচ্ছে। কিছু ঘটনায় হত্যার আলামত নষ্ট করতে রেললাইনে লাশ ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। সম্প্রতি কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ফেনীতে এমন কয়েকটি ঘটনা পাওয়া গেছে।
ব্রিটিশরা ৪৪৪ ধারায় দ্রুতগতির যান হিসেবে রেলের চালককে ‘দায়মুক্তি’ দিয়ে গেছে। এর অর্থ হলোÑ রেলের সাথে সংঘর্ষ হলে চালক রেহাই পাবেন। আর রেললাইনের ১৫ ফুটের মধ্যে কোনো স্থাপনা বা বসতি থাকার কথা নয়; কিন্তু থাকছে। বাধ্য হয়ে মানুষ ঝুঁকি নিয়ে অহরহ রেললাইন পার হচ্ছে। বস্তুত একাধিক কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের কারণে রেলের সার্বিক নিরাপত্তায় বিঘœ ঘটছে। বাড়ছে দুর্ঘটনা। রেললাইন পারাপারের লেভেলক্রসিংয়ে তৈরি হয়েছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। রেলওয়ের হিসাবে দেশে বৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা এক হাজার ৪১২টি; এর ৯৪৬টিতেই নেই গেটকিপার। এ ছাড়া রেললাইনের উপর দিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা রাস্তা নির্মাণ করায় ২০১৯ সাল পর্যন্ত অবৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৮৫টি, যা আরো বেড়েছে। ফলে অরক্ষিত ক্রসিংয়ে নিয়মিত দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে পথচারীরা। দেশে নিয়মিত বিরতিতে ট্রেন দুর্ঘটনার বিষয়টি এখন প্রতিকারহীন হয়ে পড়েছে বলে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বড় কোনো ঘটনা ঘটলে তখন চার দিকে আলোচনা হয়, তদন্ত হয়, কর্তৃপক্ষও সাময়িকভাবে তৎপর হয়; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। অথচ রেল ঘিরে বিশাল বিনিয়োগ হচ্ছে। বাস্তবে নিরাপত্তার দিকে নজর না দিলে রক্তক্ষরণ অর্থাৎ প্রাণহানি থামবে না।
রেল সড়কের উপর দিয়ে স্বাভাবিক চলাচলই নয়; রীতিমতো হাটবাজার বসছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কোথাও বস্তি কিংবা বাসাবাড়িও রেল সড়ক ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। এমনকি রেলের জায়গা দখল করে রেল সড়কের পাশেই প্রভাবশালীরা মার্কেট গড়ে তুলেছে। এসব বন্ধ করতে না পারলে রেলপথ নির্বিঘœ ও নিরাপদ করা সম্ভব হবে না। বেশ কিছু কারণে রেললাইনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে রয়েছে সচেতনতার অভাব, অরক্ষিত ক্রসিং, অননুমোদিত ক্রসিং, গেটম্যান না থাকা, ঝুঁকিপূর্ণ লাইন ও সেতু এবং রেললাইন ঘিরে হাট-বাজার।
সড়কপথের মতো রেলপথও যদি অনিরাপদ ও দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে ওঠে, তা বেদনার। এটি স্পষ্টÑ রেলের অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তাহীনতা, জমি বেদখলসহ নানা কারণে প্রতি বছর এ খাতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। দেশের স্বার্থে রেল খাত লাভজনক করা এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সারা দেশে নিরাপদে রেললাইন পারাপারের স্বার্থে ফুটওভারব্রিজ নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় সবধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রেলের সার্বিক নিরাপত্তা-ব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই। একাধিক কর্তৃপক্ষ থাকলেও সমন্বয় করে রেলপথ নিরাপদ করতে হবে। তবেই সম্ভব দেশে ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষের মৃত্যু কমিয়ে আনা।

 


আরো সংবাদ



premium cement