২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো টর্চার চেম্বার

দুর্বৃত্তদের বিচার করতে হবে

-

বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ছাত্র নির্যাতনের চরিত্র আগের মতোই অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পৈশাচিক কায়দায় রাতভর নির্যাতন চালিয়ে হত্যার পর প্রতিবাদ বিক্ষোভের ঝড় ওঠে। আন্দোলনের জোয়ারে বুয়েটে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী চক্র উৎপাটিত হয়েছে। আশা করা হয়েছিল, এর সূত্র ধরে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এই সন্ত্রাসীরা বিতাড়িত হবে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত বিরতিতে ছাত্র নির্যাতন হচ্ছে। গতকাল খবর পাওয়া গেল, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ‘টর্চার সেলের’। ক্যাম্পাসে সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনার বিচার সময়মতো না হওয়ার কুফল এটি।
ময়মনসিংহের ত্রিশালের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসনের দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র ওয়ালিদ নিহাদকে টর্চার সেলে আটক করে রাতে গুরুতর নির্যাতন করা হয়েছে। প্রথমে তাকে ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা দেয়া হয়। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। তার অপরাধ হচ্ছে তিনি ছাত্রলীগ করবেন না। দুর্বৃত্তদের মতে, ক্যাম্পাসে থাকতে হলে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতে হবে। বিস্তারিত বিবরণে জানা যাচ্ছে, নিহাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের এলাকায় থাকেন। ব্যক্তিগত কাজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের একটি কক্ষে যান। রাত ১২টায় তাকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী ৩২৪ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যায়। তারা তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রকিবুলের অনুসারী হয়ে চলার আদেশ দেয়। তিনি তাদের এমন আদেশে সায় না দেয়ায় নেমে আসে তার ওপর অকথ্য নির্যাতন। সমানে তাকে কিলঘুষি চরথাপ্পড় মারতে থাকে। অন্তত ১৫ জন ছাত্রলীগ কর্মী তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজত্ব কেমন চলছে তা বোঝার জন্য এ ঘটনার আরো কিছু দিক যা সংবাদমাধ্যমে এসেছে তা তুলে ধরা প্রয়োজন। দুর্বৃত্তরা যখন তাকে পেটাচ্ছিল তখন রাকিবুল কতটা ক্ষমতাধর সেটি উল্লেখ করেছে। তারা বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ ও বদলি হওয়ার মতো ঘটনা তিনি ঘটান। তাই তাকে মেনে তার অনুসারী হয়ে ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে হবে। নির্যাতন চালানোর সময় তারা নিহাদকে হুমকি দিয়ে বলে, ‘বেশি লাফাইলে মরবি আবরারের মতো’। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের এভাবে সারা দেশে সন্ত্রস্ত করে রাখা হয়েছে। আবরার হত্যার পর তা কিছুটা স্তিমিত হলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা আবার আগের রূপে ফিরে যায়। এভাবে একটি উচ্চশিক্ষিত জাতি কোনোভাবে গঠন করা যায় না।
স্টুডেন্ট অ্যাগেইনস্ট টর্চার (স্যাট) নামের একটি সংগঠন খবর দিচ্ছে, গত পাঁচ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। করোনার পর বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হলে এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ছোটখাটো কারণে নির্দিষ্ট রুমে নিয়ে এ নির্যাতন চালানো হয় যা গেস্টরুম টর্চার নামে কুখ্যাতি পেয়েছে। সাধারণত নিজেদের অনুগত করে রাখা, মিছিলে যাওয়া ও নিজেদের লাঠিয়াল বানানোর জন্য এ নির্যাতন চললেও অনেকসময় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর নির্যাতনমূলক কর্মকাণ্ডেও তারা লিপ্ত হয়। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় খুব কম ক্ষেত্রে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ নির্যাতনের ঘটনার মাত্র তিনটিতে প্রশাসন নামমাত্র ব্যবস্থা নিয়েছে। এতে করে ছাত্র নামের সন্ত্রাসীরা আরো উৎসাহিত হয়েছে।
ছাত্রলীগের এমন দুর্বৃত্তপনায় শুধু কিছু ছাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এমন নয়। এতে শিক্ষকরাও প্রায় আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন। তারা স্বাচ্ছন্দ্যে শিক্ষাদান ও প্রশাসনিক কাজ চালাতে পারেন না। দুর্বৃত্তদের অধীনে থেকে অন্যায় অবিচার মাথা পেতে নিলে এক কথা। অন্যথায় তাদের জীবনে লাঞ্ছনা অপমান নেমে আসে। এমন একটি ঘটনায় খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষক কয়েক মাস আগে প্রাণ হারিয়েছেন। ক্যান্টিন কারা চালাবে, সামান্য কারণে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। তিনি ছাত্রলীগের ওই চাপ নিতে পারেননি। এ ছাড়াও প্রতিনিয়ত শিক্ষাকার্যক্রম প্রায়ই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাদের সন্ত্রাসের কারণে। তারা জড়িয়ে পড়েছে ভিসি নিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগের মতো ঘটনায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও নিয়োগবাণিজ্যও একই কারণে মহামারী আকার ধারণ করেছে। এই অরাজকতা এভাবে চলতে দেয়া যায় না। অচিরেই সরকারকে এসবের রাশ টেনে ধরতে হবে, অপরাধী ছাত্রদের বিচার করতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement