২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
জাহাজ চলা কালীগঙ্গা এখন পানিশূন্য

চাই ব্যাপকভিত্তিক খনন

-

মানিকগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কালীগঙ্গা মৃতপ্রায়। বর্ষা মৌসুম ছাড়া বছরের প্রায় পুরো সময়ই থাকে পানিশূন্য। নদীটি বর্তমানে পানিশূন্যতায় অস্তিত্ব সঙ্কটে। অথচ নদীটিতে একসময় জাহাজ চলত। তিন যুগ আগেও বড় বড় নৌযান চলতে দেখা গেছে। কালীগঙ্গা ঘিরে গড়ে ওঠা তরা-বানিয়াজুড়ির সেই নৌপথের কথা এখনো অনেকের মনে আছে। নৌপথটি পদ্মা-যমুনার আরিচা-দৌলতদিয়া বা আরিচা-নগরবাড়ী রুটের চেয়ে খুব ছোট ছিল না; কিন্তু এখন নদীটির অবস্থা এতই করুণ যে, এর দিকে তাকালে চোখে পড়বে ধু-ধু বালুচর, কোথাও চাষাবাদে ব্যস্ত কৃষক, কোথাওবা গরু-ছাগল-ভেড়া চরছে; কিংবা শিশু-কিশোররা খেলাধুলায় মত্ত।
নয়া দিগন্তের ঘিওর (মানিকগঞ্জ) সংবাদদাতার পাঠানো এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জেলার সদর ও ঘিওর উপজেলা সদরের বেউথা, বান্দুটিয়া, পৌলী এবং ঘিওরের তরা, উত্তর তরা, কালীগঙ্গায় বিশাল বিশাল চর পড়েছে। চরে আবাদ হচ্ছে ফসলের। অনেক জায়গায় চলছে নদী দখল।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, কালীগঙ্গার দৈর্ঘ্য ৭৮ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ২৪২ মিটার। জেলার দৌলতপুরের চরকাটারিতে যমুনা থেকে উৎপন্ন হয়ে কালীগঙ্গা আরেক উপজেলা ঘিওরের আশাপুরের পাশ দিয়ে জাবরা, দুর্গাপুর ও তরা এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ধলেশ্বরীর সাথে মিশেছে। সেখান থেকে গালিন্দা, নবগ্রাম, চরঘোসতা, আলীগড় চর, শিমুলিয়ায় এসে পদ্মায় মিশেছে। এখান থেকে আরো খানিকটা এগিয়ে হাতিপাড়া, বালুখন্দ, পাতিলঝাপ, শল্লা হয়ে আলীনগরে এসে ধলেশ্বরীতে মিশেছে।
কালীগঙ্গায় শুধু নৌযান চলাচলই বন্ধ হয়নি, মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা হাজার হাজার জেলে পরিবারেও চলছে দুর্দিন। মৎস্যজীবী অনেকে মাছ শিকার ছেড়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। যারা বাপ-দাদার পেশা বদলাতে বিকল্প খুঁজে পাননি, তাদের জীবন কাটছে প্রচণ্ড অর্থ কষ্টে। বছরের বেশির ভাগ সময় নদী পানিশূন্য থাকায় নদী তীরবর্তী সেচকাজও ব্যাহত হচ্ছে। সেচকাজে পানির তীব্র সঙ্কট নদীপাড়ের কৃষকদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ফলে কৃষিকাজ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অথচ বছর বিশেক আগেও এত খারাপ অবস্থা ছিল না। তখনো নদীপাড়ের মানুষ নদীতে মাছ ধরতেন। গোসল করতেন। গৃহস্থালির সব কাজ সারতেন নদীর পানি দিয়ে। আর সেচকাজ তো ছিলই।
ভূগর্ভের পানিই ছিল কালীগঙ্গা পাড়ের বাসিন্দাদের সেচকাজের একমাত্র উৎস। আগে নদীর পানি দিয়ে জমিতে সেচ দেয়া হতো। দীর্ঘ দিন ধরে পানি সঙ্কটে কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে। জমিতে ভালো মতো ফসল ফলাতে না পেরে এখানকার কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। নদীর উত্তর পাড়ে তরা ও বেউথা সেতু এলাকায় অবৈধভাবে নদী দখল করে ভরাট করেছেন ব্যবসায়ীরা। দু’পাড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
এমন দৃশ্য শুধু কালীগঙ্গার নয়; এ চিত্র দেশের প্রায় সব নদীরই। উজানের দেশ অভিন্ন নদীর পানি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সরিয়ে নেয়ায় আমাদের নদীগুলোর এমন দশা হয়েছে। এতে করে জলজ পতঙ্গ, পাখিসহ যেসব প্রাণী নদীর ওপর নির্ভরশীল সেগুলোও বিলুপ্তির পথে। দেশের নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এসব প্রাণীও, কমছে মাছের প্রজনন। অথচ সবার জানা, আমাদের অর্থনীতির প্রাণশক্তি নদী। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় আমাদের জমি এত উর্বর। সেই নদীই যদি শুকিয়ে যায়, তাহলে কৃষি, পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।
প্রতি বছরই কালীগঙ্গা ভাঙনের ফলে মাটি ও পলিতে ভরে যাচ্ছে। সেই সাথে অবৈধভাবে দখল, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে নদী শাসনেই কালীগঙ্গার এ দৈন্যদশা। সরকার চাইলে এখনো পারে কালীগঙ্গায় পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে। এ জন্য প্রয়োজন নদীটিতে ব্যাপকভিত্তিক খননের উদ্যোগ নেয়া। ভাঙন রোধে এবং কালীগঙ্গার স্বাভাবিক স্রোতধারা ফিরিয়ে আনতে সময় থাকতেই বড় প্রকল্প হাতে নিতে হবে বলে আমরা মনে করি।

 


আরো সংবাদ



premium cement