২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
পাটবীজে পরনির্ভরতা কাটছে না

চাই চাষবান্ধব জাত উদ্ভাবন

-

পাট উৎপাদনে একসময় বাংলাদেশ বিশ্বে এক নম্বরে ছিল। সঙ্গত কারণে আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল সোনালি আঁশ পাট। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের শুরুর দিকেই পাটের সেই সোনালি দিন ফুরিয়ে গেছে। এখন বিশ্বে পাটের বাজার ভারতের দখলে। শুধু উৎপাদনই নয়, আমাদের যে পরিমাণ পাটবীজ প্রয়োজন হয় তার বেশির ভাগই আমদানি করতে হয় ভারত থেকে। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) বিজ্ঞানীরা জিনোম গবেষণায় পাটজাত রবি-১ (তোষা পাট-৮) উদ্ভাবন করলেও ভারতীয় জেআরও-৫২৪ জাতের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। তবে এ কথাও ঠিক, দেশীয় জাতের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সংশ্লিষ্টরা এখন পর্যন্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। যার কারণে ভারতীয় জাতের কাছে মার খাচ্ছে দেশীয় উচ্চফলনশীল জাতটি।
বিজেআরআই উদ্ভাবিত তোষা পাট-৮ জাতটির জীবনকাল তুলনামূলকভাবে ভারতীয় জাতের চেয়ে একটু বেশি। ফলন একটু কম হলেও স্বল্প জীবনকালের ভারতীয় জেআরও-৫২৪ জাতটিতেই গুরুত্ব দিচ্ছেন দেশীয় পাটচাষিরা। এ ছাড়া ভারতীয় পাটের আঁশ অপেক্ষাকৃত একটু ভালো। বাজারে চাহিদাও বেশি। সর্বোপরি কৃষকদের মধ্যে দেশীয় তথা বিজেআরআইয়ের তোষা পাট-৮ জনপ্রিয় করতে কার্যকর উদ্যোগও নেই। এ অবস্থায় পাটবীজে ভারতনির্ভরতা কমছে না। বর্তমান অবস্থায় মনে করা হয়, আমাদের আরো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে পাটবীজে ভারতনির্ভরতা কাটাতে।
এ দিকে ভারত থেকে পাটবীজ আমদানিতে দীর্ঘ দিন ধরেই রয়েছে অব্যবস্থাপনা। প্রকৃত পাটবীজ আমদানিকারকদের পাশাপাশি মৌসুমি অপেশাদার অনেক লাইসেন্সধারীও পাচ্ছেন আইপি। আইপি বরাদ্দের নামে পাট মৌসুমে কিছু কামিয়ে নেয়ার সুযোগ পান নামমাত্র লাইসেন্সধারীরা। যাদের সাথে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ শাখার কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ। শুধু মৌসুমি ব্যবসায়ী নন, চাহিদা অনুযায়ী আইপি না পেয়ে বড় ব্যবসায়ীদের কারো মধ্যে গড়ে উঠেছে চক্র। তারা চাহিদামাফিক বীজ আমদানি করতে নামে-বেনামে লাইসেন্স তৈরি করে, সেসবের বরাদ্দ একসাথে করে ভারত থেকে পাটবীজ আমদানি করছেন। সব মিলিয়ে পাটবীজ আমদানিতে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। তবে ভারতীয় কয়েকটি কোম্পানির ব্র্যান্ড বাংলাদেশে পরিচিত হয়েছে। বাংলাদেশে কখন আইপি অনুমোদন হয়, কখন এলসি খোলা হয়, সেই অপেক্ষায় থাকে ভারতীয় ওই সব কোম্পানি। তখন ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দেয়। ওই প্রভাব দেশে পড়ে, তাতে অনেকসময় পাটবীজের দাম বেড়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার ২০০ টনের মতো পাটবীজের প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে বিএডিসি প্রায় ৭০০ টন বীজ সরবরাহ করে থাকে। বাকি প্রায় চার হাজার ৫০০ টন বীজই ভারত থেকে আমদানি করা হয়। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বর্তমানে ছয়-সাত লাখ হেক্টর জমিতে ৭০-৭৫ লাখ বেল (এক বেল সমান ০.২২ টন) পাট উৎপাদন হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগই তোষা জাতের। এ জাতের পাট আবাদের ৮৫-৯০ ভাগ বীজই (জেআরও-৫২৪) ভারত থেকে আমদানি করতে হয়।
বিজেআরআই বলছে, ভারতীয় জাত জেআরও-৫২৪-এর চেয়ে দেশে উদ্ভাবিত জাতটির (রবি-১ বা তোষা পাট-৮) ফলন ১০-১৫ শতাংশ বেশি। এ জাত পাটচাষিদের মধ্যে জনপ্রিয় করে পাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব। ভারতীয় জাতটি ১০০ দিনে কাটা যায়, আর বিজেআরআই জাতটিতে ১২০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। তবে দেশীয় জাতের ফলন বেশি। এ দিকটি বোঝাতে পারলে পাটচাষিদের দেশীয় জাত আবাদে উৎসাহিত না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু দেশীয় জাত আবাদে চাষিদের যথাযথভাবে উদ্বুদ্ধ করতে শত কোটি টাকার পাটবীজের ব্যবসা অন্তরায় কি না তা-ও তলিয়ে দেখা প্রয়োজন।
আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বিজেআরআই ভালো জাত উদ্ভাবন করেছে বটে; কিন্তু এখনো তা পাটচাষিদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়নি। ভারতীয় জাতটির জীবনকাল কম হওয়ায় চাষিরা বিদেশী জাত আবাদে আকৃষ্ট হচ্ছেন। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি কৃষি বিভাগকে দেশীয় কৃষিবিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আরো উন্নত জাত উদ্ভাবন করা, যাতে ওই জাত চাষে কৃষক বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement