২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
গুদাম দেখতে বিদেশ ভ্রমণ

উন্নয়ন না ভাগবাটোয়ারা

-

বিদেশ সফরে উদ্ভট সংস্কৃতি চালু করেছেন আমলারা। ‘এসির বাতাস’ পরীক্ষা করতেও বিদেশযাত্রার ঘটনা ঘটেছে আমাদের দেশে। একটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল ‘এসির বাতাস খেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা মালয়েশিয়ায়!’ গভর্নরের বাসায় এসি ঠিকভাবে কাজ করবে কি না বিষয়টি যাচাই করতে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চাহিদাপত্র তৈরি করা হলেও তার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লোপাট হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে অতটা জোরালো তৎপরতা নেই এসব কর্মকর্তার। গত এক যুগে এমন অসংখ্য বিদেশ সফরের খবর পাওয়া গেছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এসব নিয়ে জোরালো তদন্ত হয়নি। সরকারি তহবিল কিংবা উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ তসরুপে কারো শাস্তিও হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে মাহানন্দে বনভোজন করেই চলছেন।
সর্বশেষ সহযোগী একটি দৈনিকের খবরে প্রকাশ, খাদ্যগুদাম দেখতে বিদেশে যেতে চান ৩০ কর্মকর্তা। এটি খাদ্য অধিদফতরের ‘দেশের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে নতুন খাদ্যগুদাম ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ’ নামের একটি প্রকল্প। এর বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি দেশের আট বিভাগের ৫৩টি জেলায় ১২৮ উপজেলা ও চারটি সিটি করপোরেশনে বাস্তবায়িত হবে। নির্মিত হবে ১৯৬টি খাদ্যগুদাম। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তাবিত প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এ ধরনের প্রকল্প দেশের খাদ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করতে প্রয়োজনীয়।
দেশে খাদ্যগুদাম নির্মাণ নতুন কোনো বিষয় নয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই দেশে সরকারি খাদ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ ব্যাপারে খাদ্য বিভাগ এমনকি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে অভিজ্ঞ লোক রয়েছেন। প্রকল্পের প্রযোজনীয়তা, নির্মাণের স্থান ও কৌশল আমাদের ভালোভাবে জানা থাকার কথা। তারপরও এ প্রকল্পে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪০ জনকে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, আরো দুই কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩০ জনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রত্যেকের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ লাখ টাকা। পরামর্শকের জন্য রাখা হয়েছে ১৮ কোটি টাকা। সরকারের প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয়েরও আমরা এক নতুন সংস্কৃতি দেখছি। অনেক ক্ষেত্রে এ ব্যয় দেখে চোখ চড়কগাছ হয়ে যায়। মূল প্রকল্প ব্যয়ের তুলনায় পরামর্শক ব্যয় অনেক বেশি দেখানো হয়। এগুলো এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে কেউ কথা বলতে চান না।
এখন কোনো প্রকল্প প্রণয়ন করলেই দেখা যায়, অবধারিতভাবে থাকবে দু’টি বিষয়। এক, বিদেশ সফর। দ্বিতীয়টি গাড়ি কেনা। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, সরকারি-আধা সরকারি ও জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের নামে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ বেহিসাব খরচ করার প্রবণতা দিন দিন লাগাম ছাড়া হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বিদেশ সফর নিয়ে রীতিমতো হাস্যরস করছেন মানুষ। পুকুর খনন, নলকূপ স্থাপন, সড়ক সংস্কার ও নির্মাণ, বাদাম চাষ, খিচুড়ি রান্না শেখা এ ধরনের ঠুনকো ও উদ্ভট অজুহাতে বিদেশ সফরের প্রস্তাব করা হচ্ছে। ‘নিরাপদ পানি সংরক্ষণ প্রক্রিয়া প্রশিক্ষণে উগান্ডা গমন’, ‘একটি ক্যামেরা কিনতে তিনজনের বিদেশ ভ্রমণ’ সংবাদমাধ্যমে এমন শিরোনাম আমরা দেখেছি।
সরকারদলীয় লোকজনের ভাষায়, বাংলাদেশ উন্নয়নের রোলমডেল। বাস্তবে একশ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা ও সুযোগসন্ধানীর জন্য এটি অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বাধাহীন সুযোগ। উল্লিখিত বিষয় ছাড়াও প্রকল্পের সব ধরনের কেনাকাটায় বড় ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে। প্রকল্প ঘিরে উন্নয়নের চেয়ে ‘ভাগবাটোয়ারা’ অনেকের কাছে এখন আকর্ষণীয়। প্রকল্পগুলোতে যে বিপুলপরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছেÑ সরকার চাইলেই সহজে এর লাগাম টেনে ধরতে পারে। অকারণে যেসব বিদেশ ভ্রমণ হয়েছে; সেগুলো নিয়ে তদন্ত হতে পারে। যেসব প্রকল্পে বিদেশ ভ্রমণের অযৌক্তিক প্রস্তাব রাখা হয়েছে; একটু আন্তরিক হলেই ঠেকানো সম্ভব। দেশে উন্নয়ন ঘিরে যে অবাধ লুটপাট চলছে কিছুটা হলেও রাশ টেনে ধরতে পারে সরকার।


আরো সংবাদ



premium cement