২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
ঘোষিত জিডিপি নিয়ে বিভ্রান্তি

অর্থনীতির প্রকৃত চিত্রে ধোঁয়াশা

-

আমাদের দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন হিসাবের কারণে দেশের অর্থনীতি নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। ধারণা করা অসঙ্গত নয়, দেশের উন্নয়নের চিত্র রঙিনভাবে উপস্থাপন করে বাহবা পেতে চাইছে সরকার। কারণ, বৈশ্বিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে গত অর্থবছরে কোনোভাবেই সরকার ঘোষিত জিডিপির হিসাব বাস্তবতার সাথে মেলে না।
একটি সহযোগী দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে আইএমএফ বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হবে বলে ধারণা দিয়েছিল। এডিবির বিশ্লেষণে ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাংকের জরিপ ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে সরকারি সংস্থা বিবিএস বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ; যা বাজেটে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা ও আগের অর্থবছরের চেয়েও অনেক বেশি।
চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাথমিক হিসাব থেকে এতটা বাড়ল কিভাবে সেই ব্যাখ্যায় পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, অর্থনীতির প্রধান তিন সূচক কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি প্রাথমিক হিসাবের তুলনায় চূড়ান্ত হিসাবে বেশি হয়েছে। সে কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য দিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভোগ, বিনিয়োগ, প্রবাসী আয়, কৃষি ও সেবা কোনো খাতের হিসাবেই জিডিপির চূড়ান্ত এবং সাময়িক হিসাবের ব্যবধান মেলানো যাচ্ছে না। বিবিএসের পরিসংখ্যানের মধ্যে ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাথাপিছু আয়ের যে হিসাব দেখানো হয়েছে, তা-ও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, করোনার অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ঘোষণা গ্রহণযোগ্য নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত নভেম্বরে সরকার যখন সাময়িক হিসেবে জিডিপিতে ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। গত অর্থবছরের প্রথম ছয়-সাত মাসের পরিস্থিতি অনুযায়ী ওই হিসাব ছিল বাস্তবসম্মত। এখন ৬ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ঘোষণা মানে পরের মাসগুলোতে আরো ব্যাপক হারে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে। অথচ গত বছরের শেষ দিকে করোনার প্রকোপে সেবা ও শিল্প প্রায় বন্ধ ছিল। রফতানি খাত ছাড়া কোনো কার্যক্রমই স্বাভাবিক ছিল না। শুধু রফতানি আয়ের সূচক ধরে এত বেশি হারে প্রবৃদ্ধি হতে পারে না। আবার রফতানির তুলনায় আমদানি বেশি ছিল দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রফতানি আয় থেকে আমদানি ব্যয় বাদ দিলে এত বেশি অবদান থাকে না। কাজেই রফতানির ওপর ভর করে জিডিপি এত বেশি বেড়েছে- এটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নয়। প্রবাসী আয় গত বছরের প্রথমার্ধের তুলনায় শেষার্ধে কমেছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদার ক্ষেত্রেও করোনায় স্থবিরতা আসে। ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং জোগানের মতো কর্মকাণ্ডে জিডিপি এত বেড়েছে, সে কথাও বলা যাচ্ছে না। বাকি থাকে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন।
সরকারের হিসাব অনুযায়ী, টাকায় এডিপির ব্যয় বেড়েছে আগের অর্থবছরের তুলনায় ২ দশমিক ৭ শতাংশ। আবার প্রকৃত অর্থে ব্যক্তি খাতের ঋণ বেড়েছে আগের অর্থবছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এর থেকে প্রায় ৬ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি বাদ দিতে হবে। সুতরাং কোনো ব্যাখ্যায় প্রায় ৭ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের সরকারি ঘোষণার হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি বিস্ময়কর- যে তিন মাস করোনার প্রকোপ বেশি ছিল, সেই সময়ের তথ্য যোগ করে বিবিএস বলছে আগের হিসাবের চেয়ে ১ দশমিক ৫১ শতাংশ পয়েন্ট বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে দেশে। এটা কিভাবে সম্ভব?
অর্থনীতিবিদদের মতো আমরাও মনে করি, বিবিএসের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির সঠিক চিত্র ফুটে ওঠেনি। এর ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করলে উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। সরকারের নীতি-নির্ধারকদের মনে রাখা প্রয়োজন, যদি দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র না পাওয়া যায়, তথ্য না পাওয়া যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সঠিকভাবে নেয়া যাবে না। উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement