২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
লতা মঙ্গেশকর পরলোকে

বেঁচে থাকবেন সঙ্গীতে

-

চিরবিদায় নিলেন কিংবদন্তিতুল্য কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। গতকাল রোববার সকালে ভারতের মুম্বাইয়ে একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। করোনা-উত্তর জটিলতায় ৯২ বছর বয়সে শেষ হলো তার কর্মময় পথচলা। অবসান হলো উপমহাদেশের সঙ্গীতের দীর্ঘ সাত দশকের এক বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে ভারতে। শোক জানিয়েছেন রাজনীতিবিদ, ক্রীড়াবিদ থেকে শুরু করে নানা জগতের মানুষ। ভারতে দু’দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে।
সাত দশক ধরে কণ্ঠের জাদুতে দর্শক-শ্রোতার হৃদয় তৃপ্ত করেছেন এই মারাঠি শিল্পী। ১৯২৯ সালে ভারতের ইন্দোরে সাধারণ পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। বাবার মৃত্যুতে অল্প বয়সেই সংসারের দায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। সেই সংগ্রামের হাতিয়ার ছিল তার কণ্ঠ। ১৩-১৪ বছর বয়সে প্রথমে মারাঠি গান গেয়ে শুরু করেন সঙ্গীতজীবন। পরে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শেখেন উস্তাদ আমান আলী খানের কাছে। কণ্ঠস্বর বড় বেশি চিকন বলে যখন বড় সঙ্গীত পরিচালকদের কেউ লতাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন; তখন তার এগিয়ে যাওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন গোলাম হায়দার নামে একজন চিত্র পরিচালক। ১৯৪৮ সালে গোলাম হায়দার তার ‘মজবুর’ ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ দেন লতাকে। সেই তার প্রথম বড় সুযোগ। সেই গানেই ব্যাপক সাড়া ফেলেন লতা। পান বিপুল খ্যাতি।
ভারতরতœ সম্মানে ভূষিত লতা প্রথম জীবনে অভিনয়ও করেছেন। কিন্তু অভিনয় তাকে টানেনি। আজীবন জড়িয়ে ছিলেন গানের সাথেই। শুরুর দিকে পাকিস্তানের বিখ্যাত শিল্পী নুরজাহানকে নকল করার অভিযোগ করেন অনেকে। দিলীপ কুমার প্রশ্ন তোলেন লতার উর্দু উচ্চারণ নিয়ে। ফলে উর্দু শেখেন লতা। পঞ্চাশের দশক থেকে সঙ্গীতের জগতে লতার কণ্ঠ জড়িয়ে আছে। তার কণ্ঠমাধুরী নেশা ছড়ায় সমগ্র দেশ ও দেশের বাইরে। শুধু হিন্দি ছবির গান নয়। গীত-গজল-ভজন-দেশাত্মবোধক গানে পুরো দেশবাসীকে মুগ্ধ করে রাখেন সবসময়। তার গলার রোমান্টিকতা আজো ভারতীয় রোমান্সের শেষ কথা।
গত সাত দশকে বিশ্বের ৩৬টি ভাষায় অন্তত ৩০ হাজার গান গেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে বাংলাও অন্যতম। ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’, ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’, ‘ও মোর ময়না গো’, ‘ও পলাশ ও শিমুল’, ‘আকাশ প্রদীপ জ্বেলে’র মতো গানগুলো বাঙালি শ্রোতা কখনো ভুলবে না। আর সারা উপমহাদেশের মানুষের কাছে অমোচনীয় স্মৃতি হয়ে থাকবে, ‘এক পেয়ার কা নাগমা হ্যায়’, ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’, ‘দিদি তেরা দেবর দেওয়ানা’, ‘এক রাধা এক মিরা’র মতো অসংখ্য সুপারহিট গান।
ছদ্মনামে গানের পরিচালনাও করেছেন তিনি। পুরস্কারও জিতেছেন। কিন্তু তার সঙ্গীতজীবন দেশ, জাতি, রাষ্ট্রের চাহিদার ঊর্ধ্বে নিছক ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই আদর্শে নিবেদিত ছিল না। দেশের সঙ্কটকালে গান গেয়েছেন জাতিকে সাহস জোগাতে, উদ্বুদ্ধ করতে তিনি। ভারত-চীন যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাদের প্রেরণা দিতে তিনি গেয়েছিলেন ‘ইয়ে মেরে ওয়াতান কি লোগো’ গানটি। এই গান এখন পর্যন্ত দেশটির লাখো কোটি মানুষের দেশপ্রেমের প্রেরণা হয়ে আছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তিনি দেশপ্রেম ও উদ্দীপনামূলক গান গেয়েছেন যা একজন সঙ্গীতশিল্পীর সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচয় তুলে ধরে।
লতার কণ্ঠের জাদুতে বুঁদ থেকেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। রোববার সন্ধ্যায় মুম্বাইয়ে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
নিজ সময়ের সেরা সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আমরা লতা মঙ্গেশকরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তিনি বহু কাল বেঁচে থাকবেন সঙ্গীতপিপাসু মানুষের স্মৃতির মণিকোঠায়।

 


আরো সংবাদ



premium cement