২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিরাও জড়াচ্ছেন দুর্নীতিতে

এ অবক্ষয় থেকে রক্ষা করার কেউ নেই

-

দুর্নীতি হওয়াই আমাদের দেশে একেবারে স্বাভাবিক পরিণতি হয়ে গেছে। সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি কিংবা সরকারি দফতরে নানা ধরনের অনিয়ম ও ঘুষ এখন যেন একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ ব্যাপার হয়ে গেছে। বিপুল অঙ্কের অর্থের দুর্নীতি হবে, প্রধান কর্তা থেকে অফিসের একেবারে নিম্নপদস্থরা পর্যন্ত তার ভাগ পাবেন এটা আর কোনো কৌতূহলও জাগায় না। সরকারি অফিসের গাড়িচালক, অফিস সহকারীর শত শত কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ থাকবে এমনটা আমাদের চোখ সওয়া হয়ে গেছে। এরা আবার মুদ্রা পাচার করে বিদেশে সেকেন্ড হোম বানাবে এটাও সবার জানা। বছরে গড়ে ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে। অঙ্কটি যে আরো বেশি হবে অনেকে সেটি অনুমান করেন। এই দুর্নীতি অন্তত কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে স্পর্শ করতে পারবে না এমন ধারণাও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ও অন্যান্য মহৎ কাজে জড়িতরা এই মহামারীর মধ্যে নিজেদের নিমজ্জিত করে দেয়ার মধ্যে দিয়ে পুরো জাতি যেন অন্ধকারের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে।
এখন প্রায় প্রতিদিন খবর পাওয়া যাচ্ছে শিক্ষকরা দুর্নীতিতে জড়াচ্ছেন। রাজধানী তথা দেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইডিয়াল স্কুলের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানান অনিয়ম- দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে কয়েক বছর ধরে। অথচ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম ‘আইডিয়াল’; বাংলায় বলা যায় ‘আদর্শ’। সাধারণত মানুষের ধারণা থাকে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতি হতে পারে না। তার ওপর নারীদের প্রতি থাকে আলাদা আরেকটি বিশ্বাসযোগ্যতা। তারা অন্তত দুর্নীতির ঢলে নিজেদের গা ভাসিয়ে দেবেন না। দেখা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটিতে ছাত্র ভর্তি করা হয়েছে নিয়মের বাইরে গিয়ে। এ জন্য একেকজনের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। অনুত্তীর্ণ ছাত্রদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নিয়ে ফরম ফিলাপের সুযোগ দেয়ার অভিযোগও উঠেছে। স্কুলটির কয়েকটি শাখা রয়েছে। প্রত্যেক শাখায় এ ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতানো হয়েছে বলে অভিযোগ। দুর্নীতি দমন কমিশন আইডিয়াল স্কুলের অধ্যক্ষ শাহান আরার অবৈধ সম্পদের খোঁজে ৫৮টি ব্যাংকসহ ৬৮টি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে।
নতুন করে দেখা গেল, শিল্পকলা একাডেমির খোদ মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিপুল অভিযোগ উঠেছে। শিল্পকলা একাডেমি জাতির মানসিক বিকাশের জন্য কাজ করে। চারুকলা, নাট্যকলা, সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি ও বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণাকাজ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জাতির মানবিক বিকাশ সাধন করা এর অন্যতম কাজ। লিয়াকত আলী সেখানে বসে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন। ভুয়া বিল-ভাউচার করে তিনি কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে খবর প্রকাশ হচ্ছে। অনিয়মের মাধ্যমে তিনি ২৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটি তার ব্যাপারে অনুসন্ধান করার সুপারিশ করেছে। একটি অভিযোগ কতটা বিশ্বাসযোগ্য হলে সংসদীয় কমিটি তার বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেয় সেটি সবার জানা।
অনিয়ম-দুর্নীতি সমাজের একটি সাধারণ ধারণা। যখন মানুষ সুযোগ পায় সে নীতিভ্রষ্ট হয়। আর যখন বেশি সুযোগ পায় সে বেশি করে এতে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের দেশের বর্তমান প্রবণতা হচ্ছে দুর্নীতির সর্বব্যাপী বিস্তার। বাদ যাচ্ছে না একেবারে শুদ্ধ প্রতিষ্ঠান ও ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিরা। অন্য কথায় বললে যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন তারা নিজেরাই এতে জড়িয়ে পড়ছেন। শিল্পকলার মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে অর্থপাচারেরও অভিযোগ আছে। এখন প্রশ্ন, এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সচেতনভাবে দুর্নীতিবাজদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, না ভালো লোকেরা দুর্নীতির জোয়ারে নিজেদের ভাসিয়ে দিচ্ছেন? প্রতিকার পাওয়ার জন্য এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। আর যদি কোনো একটি গোষ্ঠী জাতির মননকে ধসিয়ে দেয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে এটা করে, তাহলে এ থেকে জাতিকে রক্ষা করবে কে? আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের কাছ থেকে দুর্নীতির হাতেখড়ি নিচ্ছি। আবার আমরা শুদ্ধাচারের কথা যার কাছে শুনব তার কাছ থেকে পাচ্ছি মুদ্রাপাচারের কৌশল। একটা জাতির জন্য এমন অবক্ষয় নজিরবিহীন। নিজেদের পুরোপুরি দুর্নীতির কাছে সঁপে দেয়ার এমন উদাহরণ হয়তো দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই ফিরতে হবে। অন্যথায় আমরা সম্ভবত পৌঁছে যাবো ধ্বংসের কিনারায়।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement