২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
গবেষণায় আগ্রহ নেই বিশ্ববিদ্যালয়ে

জ্ঞানচর্চায় পাওয়া যাচ্ছে না উৎসাহ

-

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে হতাশার কথা শোনা যায়। বৈশ্বিক পরিসরে নামী-দামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্ঞানচর্চার ধারেকাছে দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই। শিক্ষা ও গবেষণার মানে যে বৈশ্বিক তালিকা রয়েছে তাতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তালিকায় স্থান পায় না বহু বছর। অথচ এ অঞ্চলে ঢাকাসহ যে গুটিকয় বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে প্রতিষ্ঠার শুরুতে সাড়া জাগিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বমানের জ্ঞানচর্চা সমসাময়িক বিশ্বে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল। এখানকার ছাত্র-শিক্ষকরা তাদের জ্ঞানগরিমায় আলো ছড়িয়েছেন। এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে শুধু সন্ত্রাস দলাদলি অনিয়ম দুর্নীতির খবর। ছাত্র-শিক্ষক এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ভিসিরাও এতে জড়িয়ে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও প্রকাশনা একেবারে গুরুত্ব হারিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বসাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর, রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদের কাছে গত বৃহস্পতিবার ইউজিসির দেয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে জানা যায়, ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য ২০২০ সালে কোনো অর্থ খরচ করেনি। দেশে পাবলিক-প্রাইভেট মিলে ১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণায় ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। একই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে কোনো প্রকাশনাও নেই। এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র দু-চারটি প্রকাশনা বের হচ্ছে। এগুলোতে নতুন জ্ঞানের তেমন কিছু নেই। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানচর্চায় একেবারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আটটিতে গবেষণায় কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি। এর অর্থ হচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে পুরনো ও অচল জ্ঞানের চর্চা। মুখস্থ বিদ্যার চর্বিতচর্বণ করে কিছু নামকাওয়াস্তে গ্র্যাজুয়েট তৈরির কারখানা এগুলো।
আরেকটি বিষয় লক্ষ করা গেল ইউজিসি প্রতিবেদন থেকে। সেটি হচ্ছে, গবেষণায় কিছু অর্থ ব্যয় করলেও সেই অর্থ ব্যয়ের কোনো ফল নেই। নতুন কোনো আবিষ্কার নেই, নেই কোনো প্রকাশনাও। অর্থাৎ গবেষণার নামে অর্থ ব্যয় হলেও সেটি যেন নতুন চিন্তাভাবনার উদয় ও নতুন কিছু আবিষ্কারে আসছে না। এসব অর্থ দুর্নীতির মহোৎসবের এই সময় অবৈধভাবে আত্মসাৎ হয়ে যাচ্ছে কি না সেই সন্দেহ সৃষ্টি হওয় স্বাভাবিক। আমরা দেখেছি, প্রকাশনার নামে অন্যের লেখা চুরির ঘটনাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক এ জন্য অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তাদের দণ্ড দেয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে যেসব প্রকাশনা বের হচ্ছে সেগুলোর মানে আশা জাগার মতো কিছু নেই।
গবেষণায় কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগিয়ে আসা আশা জাগার মতো বিষয়। ২০২০ সালে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। এ খাতে তারা ৫৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। এ সময় তাদের প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ৩৭৮। আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এই বছর গবেষণায় ব্যয় করেছে ১২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া আরো তিনটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রধান ও বৃহৎ পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে গবেষণায় বেশি অর্থ ব্যয় করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই বছর এ খাতে ব্যয় করেছে মাত্র ছয় কোটি ৬১ লাখ টাকা।
আমরা এমন একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় অমনোযোগী হলাম, যখন সারা বিশ্ব জ্ঞান ও গবেষণায় এগিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে নতুন নতুন জাতি। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ল্যাবরেটরিগুলো হচ্ছে জমজমাট। প্রকাশিত হচ্ছে অসংখ্য প্রকাশনা। জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন চিন্তাভাবনার। অথচ আমাদের জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে ব্যাপক গবেষণার বিশেষ প্রয়োজন। ১৭ কোটি মানুষের বৈষয়িক উন্নতির পাশাপাশি আধ্যাত্মিক কল্যাণ সাধনের জন্য গবেষণার বিস্তৃতি একান্ত প্রয়োজনীয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পণ্যের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে করে শিল্পোদ্যোক্তারাও এ ক্ষেত্রে অর্থ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন। পাশাপাশি গবেষণাকারী যত প্রতিষ্ঠান রয়েছে সব জায়গায় চলতে পারে নতুন নতুন গবেষণা প্রকল্প। জাতি যখন উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে সেটিকে টেকসই করার জন্য গবেষণা একান্ত প্রয়োজন। দুর্ভাগ্য, জাতি এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে সঠিক নির্দেশনা পাচ্ছে না। ছাত্র-শিক্ষকরা খুঁজছেন অর্থ কামানোর সংক্ষিপ্ত পথ। আমরা আশা করব, জাতির বৈষয়িক ও আত্মিক উন্নয়ন মসৃণ করার জন্য গবেষণায় মনোযোগী হওয়ার পথই আমরা বেছে নেবো।

 


আরো সংবাদ



premium cement