২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
বিদায় ২০২১

এ বছরটিও ভালো কাটেনি

-

আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে আরো একটি বছর। কালের অতলে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া বছরটিতে আমাদের অর্জন কী? সেই বিবেচনা করলে সূচকগুলো অধোমুখী দেখতে পাই। মানুষের স্বাধীনতা ও কথা বলার অধিকারে আগের বছরগুলোর মতো হতাশার চিত্র বেড়েছে। বহু বিষয়ে সরকারের একগুঁয়েমিকে মেনে নিতে হয়েছে জাতিকে। এই গুমোট হাওয়া পুরোদমে আমাদের গ্রাস করে রেখেছে। উন্নয়নের কথা জোরালোভাবে বলা হচ্ছে। এই একটি ক্ষেত্রে সূচক ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। করোনাকালে প্রমাণিত হয়েছে, মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কমেছে। দরিদ্রের হার আগের চেয়ে বেড়েছে। উন্নয়নের বিকার হিসেবে খুব সামান্য কিছু মানুষের অর্থবিত্ত বিপুল বেড়ে গেছে। তাদের ক্ষমতা প্রতিপত্তিও বেড়েছে। ক্ষমতার সাথে এই অর্থবিত্ত বৃদ্ধির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে।
২০১৪ সালে অনেকটাই বিনা ভোটে বর্তমান সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। জাতিকে ওই সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- সুযোগ মতো একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও তখন একইভাবে আশ্বস্ত করা হয়েছে। দেখা গেল, ক্ষমতাসীন দল খুব অল্প সময়ের মধ্যে তা ভুলে গেছে। ওই সরকার ২০১৮ সালে নিয়ম-কানুনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অনিয়ম করে আবারো ক্ষমতা গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে আগের রাতেই তারা ভোট সম্পন্ন করে ফেলে। সেই থেকে জনগণের কাছে ভোটের অধিকারটি আর যেন থাকল না। এখন স্থানীয় সরকারের কোনো পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের আর কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাই এখন নিরঙ্কুশ। তারা যাকে চাইবে সে-ই মেয়র-কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান-মেম্বার। এর বাইরে আর কোনো বিকল্প নেই।
সুশাসন দিয়ে অনির্বাচিত সরকারও জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে- আমাদের বর্তমান সরকার এককভাবে সব সুযোগ-সুবিধা নিজেরাই গ্রহণ করছে। এই ক্ষেত্রে বিরোধী মত একেবারেই উপেক্ষিত। সাধারণ জনগণও মোটাদাগে বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে। জানা যায়, প্রতি বছর দেশ থেকে গড়ে ৭১ হাজার কোটি টাকা করে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থপাচারের সাথে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর লুটপাট ও উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্যে দেশে কালো অর্থনীতির বিপুল বিস্তার ঘটেছে। তার একমাত্র সুফলভোগী অল্প কিছু মানুষই। কালো অর্থনীতির ধারা ২০২১ সালেও একই রকম ছিল। কারণ এ বছরও আমরা দেখিনি কোনো দুর্নীতিবাজ লুটপাটকারীর বিরুদ্ধে সরকার কঠিন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিগত এক যুগ ধরে ক্রমান্বয়ে অবনত হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা-গুম-খুন একটি নিয়মিত ঘটনা হিসেবে রয়েছে। প্রথম দিকে কেবল বিরোধী দলের লোকদের বিরুদ্ধে গুম-খুনের ঘটনা ঘটানোর অভিযোগ পাওয়া গেলেও পরের দিকে তার কুফল ভোগ করেছে সাধারণ মানুষ। অভিযোগের পাল্লা দিন দিন ভারী হলেও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলো কখনো এসব অন্যায় কর্মকাণ্ডের তদন্ত করেনি। দেশের মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার কথা থাকলেও খোদ বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। সরকাও তার অধীনস্থ বাহিনীর এই ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করেই আসছে। এর ফল যে ভালো হয়নি সেটি এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও এর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সামরিক বাহিনীর সাবেক এক প্রধানের ভিসা বাতিল করেছে তারা। অন্য দিকে জাতিসঙ্ঘও এসব ব্যাপারে সরকারকে জবাবদিহিতা করার তাগিদ দিচ্ছে। একটি দেশের জন্য এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত লজ্জাজনক। এর নেতিবাচক প্রবণতা আমাদের বাহিনীগুলোর ওপরও দীর্ঘমেয়াদে পড়বে। এর পরিণাম কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় আমরা জানি না। শেষ পর্যন্ত এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল দেশ। ধর্ষণসহ মানুষের ওপর নিপীড়নের ঘটনাও প্রতিদিন বর্ধিতহারে ঘটছে। পর্যটন এলাকায় প্রকাশ্যে ধরে নিয়ে ‘ক্ষমতার সাথে যুক্ত’ ব্যক্তিরা ধর্ষণ করছে। এ ধরনের ঘটনা পুনঃপুন ঘটলেও অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাচ্ছে না। ফলে ২০২১ সালে এর ক্রমবর্ধমান প্রবণতা আমরা দেখলাম।
বছরটিতে আমাদের রাষ্ট্র্রে রাজনীতি, বিচার, সমাজ ও সংস্কৃতির অবক্ষয় দেখেছি। এর বিপরীতে শুদ্ধতা, সংশোধনের উদ্যোগ জোরালো দেখা যায়নি। প্রায় সব জায়গায় পরিলক্ষিত হয়েছে এক বন্ধ্যাভাব। এভাবে একটি জাতি বেশি দিন টিকতে পারে না। নৈরাশ্যের সাথে বছরটি শেষ হলেও আমরা আশা করব, শুভ ও সংস্কারের কাজ শুরু হবে। যত তাড়াতাড়ি সেটি শুরু হয় ততই মঙ্গল।


আরো সংবাদ



premium cement