২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
বর্ধিত হারে মুদ্রা পাচার অব্যাহত

দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন

-

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। শীর্ষ মুদ্রা পাচারকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম দিকে থাকার খবর গত এক দশকের প্রবণতা। ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে) এবং পানামা পেপারসসহ চোরাই অর্থ নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠনগুলোর বেশ কয়েক বছরের প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার হচ্ছে। অথচ অর্থপাচারকারীদের শনাক্ত করা এবং পাচারকৃত অর্থ দেশে আনার আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো রয়েছে। সরকার চাইলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় দেশের টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে পারে। আবার দোষীদের শনাক্ত করে শাস্তিও দিতে পারে। কিন্তু এসব ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ কম। ফলে প্রতি বছর বর্ধিত হারে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হলেও সরকার দর্শক হয়েই থাকছে।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদন মতে, গত ছয় বছরে চার লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ এক লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। মুদ্রা পাচার একটি অপরাধ; এটি দেশের সাথে প্রতারণার শামিল। সাধারণত আমদানি-রফতানির বিপরীতে মুদ্রা পাচার হয়। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য বেশি দেখানো হয়। এটি ওভার ইনভয়েসিং। অন্যদিকে, রফতানির বিপরীতে পণ্যমূল্য কম দেখানো হয়; যা আন্ডার ইনভয়েসিং। লক্ষণীয়, বাংলাদেশ থেকে মূলত ইউরোপ, আমেরিকাসহ ৩৬টি উন্নত দেশে পাচার হয়ে যায়। কিভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ পাচার করা হয় একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে পারে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমরা যদি চার বিলিয়ন ডলারের পণ্য কিনি, বিপরীতে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি দেখানো হয়; তা হলে এক বিলিয়ন ডলার পাচার করা হলো। মুদ্রা পাচার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশকারী সংস্থাগুলো প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ পণ্য আমদানি-রফতানি হয়েছে এবং এর দাম যাচাই করে মুদ্রা পাচারের অঙ্কের হিসাব করে। জিএফআইয়ের হিসাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ১৮ শতাংশ ভুয়া। আরো জানা যাচ্ছে, ২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্যসংক্রান্ত কোনো তথ্য জাতিসঙ্ঘকে দিচ্ছে না। কোনো একটি দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ আড়াল করতে চাইলে মুদ্রা পাচারের প্রকৃত অঙ্কটি সঠিকভাবে জানা দুষ্কর।
বাংলাদেশে বিগত এক যুগ ধরে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। সিন্ডিকেট করে ব্যাংক খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে উন্নয়ন খাতের বেশুমার দুর্নীতি। এ সময়ে প্রথম দেখা গেছে, দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পে বালিশ কেনা, পর্দা ক্রয়, চেয়ার ক্রয়- অর্থাৎ সামান্য কোনো একটি ক্রয়ের জন্য বাজেট করা হয়েছে অকল্পনীয়। প্রকল্পের মূল ব্যয়ের কথা বাদই দেয়া গেল। এর সাথে সরকারের প্রত্যেকটি বিভাগে ঘুষবাণিজ্য এ সময়ে পর্বতের চূড়ায় পৌঁছেছে। মুদ্রা পাচারের সাথে যারা জড়িত এসব মানুষ অত্যন্ত প্রভাবশালী। তারা নানাভাবে অবৈধ পথে প্রথমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন। আবার সেই প্রভাব কাজে লাগিয়ে বিদেশে পাচার করেন। এভাবে প্রতি বছর দেশ হারাচ্ছে গড়ে প্রায় লাখ কোটি টাকা। প্রতি বছরে পাচার হওয়ার অর্থ দিয়ে আমরা পদ্মা সেতুর মতো বহু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারতাম।
দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠান থাকলেও এসব সংস্থার সামনেই লুটপাট হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায়, যারা এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন; তারাই আকণ্ঠ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। আবার সরকার উদ্যোগী হয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সরকারের কর্মকাণ্ড বরং তাদের পক্ষেই যাচ্ছে। সরকার চাইলে মুদ্রা পাচারকারী চক্রগুলোকে শনাক্ত করতে পারে। আবার তাদের পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগও নিতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার মুদ্রাপাচার নিয়ে নতুন করে স্বচ্ছনীতি গ্রহণ করবে; যেহেতু মুদ্রা পাচারকারীরা দেশের শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা শাস্তি পেলে দেশ থেকে বিপুল মুদ্রাপাচারের প্রবণতা বন্ধ হবে, আশা করা যায়।


আরো সংবাদ



premium cement