২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
প্রযুক্তিগত নজরদারিতে আসছে গণমাধ্যম

সংবাদ পরিবেশন যেন বাধাগ্রস্ত না হয়

-

প্রযুক্তিগত নজরদারিতে আসবে দেশের সব গণমাধ্যমের সংবাদ গতিধারা। তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত এক প্রকল্প প্রস্তাব থেকে জানা যায়, গণমাধ্যমে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব বা মিথ্যা তথ্য প্রচারের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রে ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনছে। তাই রাষ্ট্র ও জনস্বার্থবিরোধী গুজব, অপপ্রচার শনাক্তকরণ ও নিরসনে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তাই গণমাধ্যমের সাথে সমন্বয় ও উন্নত সেবা প্রদান নামের প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। নয়া দিগন্তের একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ কথা মনে রাখা দরকার, প্রকৃত তথ্য যখন কেউ পায় না; তখনই অসত্য গুজবের ডালপালা চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সব সোস্যাল মিডিয়া অনলাইন, অফলাইন এবং টিভি চ্যানেল-ভিত্তিক সংবাদগুলোর নিয়মিত আর্কাইভিং এবং অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে নিজস্ব মিনি ডাটা সেন্টারে সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা; আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিয়মিত নির্দিষ্ট তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন প্রণয়ন করা; রাষ্ট্র ও জনস্বার্থবিরোধী গুজব, অপপ্রচার শনাক্তকরণ ও নিরসন করা। সেখানে আরো বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। টেলিভিশন চ্যানেল, এফএম এবং কমিউনিটি রেডিওতে অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন মিডিয়া বা সোস্যাল মিডিয়ার বিস্তৃতিও বেড়েছে। এখন সনাতন পদ্ধতিতে গুজব প্রচার শনাক্তকরণ এবং তা নিরসন সম্ভব নয়। এসব কারণেই তথ্য অধিদফতরে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা বা ডিজিটাল আর্কাইভিং ব্যবস্থা খুব দ্রুত স্থাপন করা প্রয়োজন। প্রকল্পে বর্ণিত প্রযুক্তিটি একটি ওয়েব ক্লায়েন্টের মাধ্যমে যেকোনো অবস্থান থেকে তথ্যকে সহজেই খুঁজে পাবে। সেই তথ্য একাধিক ডিভাইসের মাধ্যমে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। প্রযুক্তিটি মূল প্রকাশনার প্রতিটি পৃষ্ঠার প্রতিটি তথ্য ও বিষয় হুবহু ডিজিটাল অনুলিপি হিসেবে রূপান্তর করবে। ডিজিটাল আর্কাইভিং সফটওয়্যারটি মূল সংবাদপত্রের চেহারা এবং অনুভূতি ধরে রাখার সাথে প্রকাশকের মূল কপিরাইটটিও সংরক্ষণ করবে। এর মাধ্যমে যেকোনো দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ ডিজিটাল পদ্ধতিতে সুচারুরূপে সংরক্ষণ বা আর্কাইভ করা যাবে। প্রয়োজন মতো তা ব্যবহার করা যাবে। সব গণমাধ্যমের সংবাদ গতিধারা সহজেই নজরদারি করা যাবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লিখিত প্রকল্প আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ বলে ধরে নিয়েও বলা যায়, আমাদের দেশে যে উদ্দেশ্যে গণমাধ্যমবিষয়ক কোনো আইন বা প্রকল্প অতীতে প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতে আগে সরকারের পক্ষ থেকে জোর দাবি করা হয়েছে, এটি সর্বৈব নাগরিক কল্যাণের জন্য প্রণয়ন করা হচ্ছে। শেষাবধি দেখা গেল, চূড়ান্তভাবে নিবর্তনমূলক। এর জ্বলন্ত নমুনা হলোÑ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ আইন বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর কণ্ঠ রোধ করতে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহত। অথচ আইনটি কার্যকর করার আগে বলা হয়েছিল, এটি দেশের নাগরিকদের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে; নাগরিকদের অবাধ মতপ্রকাশ এবং সংবাদমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনে কোনো ধরনের ব্যত্যয় সৃষ্টি করবে না; কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। এই আইনে বহু সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। অনেক গণমাধ্যমকর্মী মামলার ফাঁদে পড়ছেন।
এমনিতেই আমাদের দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার অবস্থা বৈশ্বিক সূচকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে খুবই নাজুক। সরকার এবং সরকারি দলের শীর্ষ ব্যক্তিদের কাজের যৌক্তিক কোনো সমালোচনা করলেও পড়তে হয় বিপদে। আর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জায়গা দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। এখানে সংবাদমাধ্যমগুলো সরকারের খড়গ থেকে বাঁচতে এবং বিপদ এড়াতে সেল্ফ সেনশরশিপের পথ বেছে নিয়েছে। এমন একটি দমবন্ধ পরিবেশ যেখানে বিরাজ করছে, সেখানে সংবাদের গতিধারা ডিজিটাল নজরদারিতে আনার জন্য উদ্যোগ নেয়ার বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে চিন্তিত না হয়ে পারেন না। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মানসিকতা এখন এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, বাংলায় একটি প্রবাদ আছেÑ ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়’, এমন আর কি!
সঙ্গত কারণে বলতে হচ্ছে, গণমাধ্যমবিষয়ক যেকোনো প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে এ খাতের সংশ্লিষ্ট সবার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করা জরুরি বৈকি। তা না হলে এটিও একটি ‘মতলবি প্রকল্প’ হিসেবে দেখবেন সংবাদমাধ্যমের সাথে সম্পৃক্ত সবাই।


আরো সংবাদ



premium cement