২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
চিকিৎসা নিতে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ

সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সুদূর পরাহত

-

করোনা মহামারী বিশ্বজুড়েই চিকিৎসাসেবায় বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ব্যতিব্যস্ত স্বাস্থ্য বিভাগ অন্য সব রোগের চিকিৎসা এমনকি নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচিও অব্যাহত রাখতে পারেনি। ফলে নানা ধরনের রোগের বিস্তার ঘটছে। সেই সাথে চিকিৎসা খাতে মানুষের ব্যয় বিপুলভাবে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে পরিস্থিতি আরো গুরুতর।
গত রোববার সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দিবস উপলক্ষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও বিশ্বব্যাংক পরিপূরক দু’টি গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশ করে যৌথ বিবৃতি দেয়। সেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের দু’টি প্রধান সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো স্বাস্থ্য পরিষেবার সীমিত পরিধি ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলার কার্যকর কৌশলের অভাব। বলা হয়েছে, চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা খুবই অনিয়ন্ত্রিত। সেবাদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার প্রসঙ্গও উঠে আসে পর্যবেক্ষণে। স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়াতে সরকারের নানা উদ্যোগের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সরকারকে প্রত্যেক নাগরিকের চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। সেই সাথে রিপোর্টে এমনো মন্তব্য করা হয় যে, প্রধানত মা ও নবজাতক এবং শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেয়া না হলে এবং রোগীকে যদি সব ব্যয় নিজের পকেট থেকেই করতে হয়, তাহলে সরকার সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ২০৩০-এর লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বলতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এমন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বোঝায়, যেখানে ধনী বা গরিব প্রতিটি নাগরিক পুরোপুরি চিকিৎসা পাবে।
বাংলাদেশে এ ধরনের সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সুদূর পরাহত তা আমরা সবাই জানি। আমাদের বিভিন্ন গবেষণায়ও বিষয়টি স্পষ্ট। সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে তথ্য পাওয়া গেছে, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে যত রোগী চিকিৎসা নিতে যায় তাদের মধ্যে মাত্র তিন শতাংশ ওষুধ পায়। বাকি ৯৭ শতাংশ রোগীকে নিজের টাকায় বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয়। আরো গুরুতর তথ্য উঠে আসে সেই গবেষণায়। সেটি হলো, সরকারি হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পায় না ৮৫ শতাংশের বেশি রোগী। বিভিন্ন প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে নিজের টাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয় রোগীকে। এভাবে চিকিৎসাসেবার প্রতিটি ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয় বলে আর্থিক সঙ্গতিহীন অন্তত ১৬ শতাংশ জনগোষ্ঠীই চিকিৎসা পায় না। যারা চিকিৎসা নেয় তাদের মধ্যে বছরে নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়ে ৮৬ লাখ মানুষ। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে রোগীর পরিবারের এভাবে নিঃস্ব হওয়ার বহু দৃষ্টান্ত সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই শিরোনাম হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো বিকার নেই।
গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় চিকিৎসা খাতে রোগীর পকেট থেকে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় বাংলাদেশে। রোগীকে চিকিৎসা ব্যয়ের ৭২ শতাংশই বহন করতে হয় নিজের পকেট থেকে। ভারতে এই হার ৬৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে ৫১ শতাংশ, মালদ্বীপে ২১ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম ভুটানে ১৩ শতাংশ।
এসবই শেষ কথা নয়। মূল বিষয় হলো ক্ষমতাসীনদের মানসিকতা। কোভিড-১৯-এর মতো এক অতিমারীতে যখন মানুষ চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে আতঙ্কিত সন্ত্রস্ত ও বিভ্রান্ত তখনো দায়িত্বশীল পদে অবস্থানকারীরা যেভাবে দুর্নীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে; তাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, জনসেবার মহান ব্রত নয়, নিজের আখের গোছাতেই সর্বদা ব্যস্ত তারা। মহামারী নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিপুল সাফল্যের দাবি সব বাস্তবতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। বাস্তবে এখন পর্যন্ত করোনার টিকাদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বহুদূর পিছিয়ে। শুনতে অবাক লাগবে যে, টিকাদানে ৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫তম।
এ মানসিকতা নিয়ে শুধু স্বাস্থ্যসেবা নয়, কোনো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যই অর্জন করা খুবই দুরূহ।


আরো সংবাদ



premium cement