২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
ধনী-গরিবের সম্পদের ব্যবধান

বৈষম্যহীন সমাজ দূরপরাহত

-

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হতে বাকি আর মাত্র চার দিন। এবারের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে দেশের অর্ধশত বছর পূর্তির দিন। এই দীর্ঘ সময়েও ধনী-গরিবের আয়বৈষম্য যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেছে। বরং মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে জাতীয় সম্পদের বেশির ভাগ কুক্ষিগত হয়েছে। পাকিস্তান আমলে যেখানে ২২ পরিবারের কাছে সম্পদের কর্তৃত্ব ছিল, এখন সেখানে কয়েক শ’ হয়েছে, পার্থক্য শুধু এটুকুই। এ কথা সত্যি যে, ২০ বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। অনেক মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সেই সাথে দেশে দৃষ্টিকটুভাবে বেড়েছে সম্পদের বৈষম্য।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। একটি বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন নিয়ে এ দেশের জনগণ মুক্তির জন্য জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে। বাস্তবতা হলো- ১৮ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে এখনো পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এতেই বোঝা যায়, বিগত ৫০ বছরে দেশের উন্নয়নের সুফল গুটিকয়েক মানুষের পকেটে গেছে। তারাই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। এদের উন্নতিই চোখধাঁধানো। বাকিদের জীবন ফিকে আর বিবর্ণ। দেশ আকণ্ঠ বৈষম্যে নিমজ্জিত বিধায় করোনাকালে সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। এখনো তারা মহামারীজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কবে এ ক্ষতির ফাঁদ থেকে তারা মুক্তি পাবেন বলা মুশকিল।
সম্প্রতি প্রকাশিত প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের ওয়ার্ল্ড ইন ইকুয়ালিটি ল্যাবের বৈশ্বিক অসমতা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে শীর্ষ ধনীদের সম্পদ ও আয়ের অনুপাত কিছুটা কমেছে বটে। কিন্তু একই সময়ে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বেড়েছে ছয় গুণের বেশি। দেখা যাচ্ছে, শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর সম্পদ ও আয়ের অনুপাত কিছুটা কমলেও জিডিপি যে হারে বেড়েছে, তাতে তাদের সাথে বাকিদের ব্যবধান আরো বেড়েছে। ২০২১ সালে দেশে শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর আয় মোট জাতীয় আয়ের ৪৪ শতাংশ। একই সময় দেশের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর আয় ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্য দিকে, পিছিয়ে থাকা ৫০ শতাংশ মানুষের আয় ১৭ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ শীর্ষ আয়ের মানুষের সাথে নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের ব্যবধান যোজন যোজন। তবে এই তথ্য-উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বিশ্লেষকরা। উন্নয়নশীল দেশের তথ্য-উপাত্ত নির্ভরযোগ্য নয়, বিশেষ করে সম্পদের উপাত্ত পাওয়া একরকম অসম্ভব। প্রথমত, উন্নয়নশীল দেশের ধনীদের সম্পদের একটি বড় অংশ থাকে বিদেশে। দ্বিতীয়ত, দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে যে সম্পদ কর দিতে হয়, সেই বিবরণী থেকে সম্পদের উপাত্ত সংগ্রহ করা হলে এর নির্ভরযোগ্যতা নেই বললেই চলে। মানুষ কর ফাঁকি দিতে সম্পদের প্রকৃত বিবরণী দেয় না।
সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর দেশের ১ শতাংশ শীর্ষ ধনীর বাড়িতে যেতেই পারে না। আবার হতদরিদ্রদের খুঁজে পাওয়া যায় না। এসব কারণে আয়ের পরিসংখ্যানও নির্ভরযোগ্য নয়। তবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের পরিসংখ্যান কিছুটা নির্ভরযোগ্য। সব মিলিয়ে বাস্তব চিত্র প্রতিবেদনের ভাষ্যের চেয়ে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উন্নত দেশগুলোর তথ্য-উপাত্তের নির্ভরযোগ্যতা থাকায় এসব দেশের অতিধনীদের হাতে বিশ্বের কত সম্পদ আছে, তা বের করা সম্ভব। আমাদের মতো দেশে তা আদৌ সম্ভব নয় বলেই অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে অসম দেশগুলোর একটি। বৈষম্য কমিয়ে আনতে যথাযথ নীতিপ্রণয়নে গুরুত্ব দেয়া উচিত। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রীয় ভুলনীতির কারণে দেশে অসমতা দিন দিন লাগাম ছাড়া হয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহত। উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে, যথাযথ নীতিপ্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন। কিন্তু দেশে এমন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।


আরো সংবাদ



premium cement