২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
স্বাস্থ্যঝুঁকিতে কয়লাশ্রমিকরা

শুধু রুজির জন্য অনিরাপদ জীবন

-

দেশে শ্রমজীবীদের জীবন যে খুব সস্তা, সে কথা না বলাই ভালো। মাঝে মাঝেই তারা কারখানায় দুর্ঘটনায় বেঘোরে প্রাণ হারান; এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা কিংবা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। থাকলে এত দিনে স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হতো। রাষ্ট্রের পক্ষে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের নিষ্ঠুর উদাসীনতায় আগুনে পুড়ে, পানিতে ডুবে প্রতি বছর বহু শ্রমিক প্রাণ হারাচ্ছেন। স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ না থাকায় তিলে তিলে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। ফলে তাদের জীবন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিষহ। এমন বেদনাদায়ক ঘটনার জন্ম শুধুই জীবিকার তাগিদে। যেখানে সবার মতো খেটেখাওয়া মানুষেরও নিরাপদ জীবিকা সংস্থানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের; সেখানে আমাদের দেশে এ নিয়ে কোনো দায়বোধ আছে বলে মনে হয় না।
দেশের হাজারো কয়লাশ্রমিক ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। একটি সহযোগী দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কোনো রকম সুরক্ষা সরঞ্জাম দেয়া হয় না তাদের। কর্মঘণ্টা হিসাবেও মজুরি পান না। ঢাকার পাশের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে তুরাগ নদের তীরে জাহাজ থেকে কয়লা নামানোর কাজ করেন তারা। মূলত কাজ না পাওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে এমন কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে তাদের। একটু বাড়তি আয়ের আশায় কাজ করতে আসা এসব শ্রমজীবী জানেন না এমন কাজে কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কি না। তবে উদায়স্ত হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয় তাদের। দিন শেষে শরীর আর চলতে চায় না। শুধু পরিবারের সদস্যদের মুখে দুই বেলা খাবার তুলে দেয়া এবং ধারদেনা পরিশোধ করতে এ ছাড়া আর কোনো উপায় না থাকায় অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় তাদের। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল, এই সাত মাস কয়লা নামানো হয়। এ কয়লা যায় ঢাকা ও এর পাশের জেলাগুলোর ইটভাটায়। জাহাজ থেকে কয়লা নামিয়ে ট্রাকে তোলার কাজে প্রায় ১০ হাজার মানুষ যুক্ত হন। তাদের বেশির ভাগই এপ্রিলের শেষে আবার গ্রামে ফিরে যান।
কয়লা ওঠানো-নামানোর কাজ খুবই অপরিচ্ছন্ন এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শ্রমিক ইউনিয়ন বা ট্রেড ইউনিয়নের আওতাভুক্ত হওয়া জরুরি। এতে তাদের মজুরি থেকে সুরক্ষা নিশ্চিতের সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি। তবে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক হোক, শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ট্রেড ইউনিয়নের আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। এটি করা গেলে মালিকপক্ষের সাথে তারা দর-কষাকষি করতে পারেন। ইউনিয়ন না থাকলে তাদের সেই সুযোগ সীমিত হয়ে আসে। আমাদের দেশে এনজিওগুলো বিভিন্ন খাতে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করলেও কয়লাশ্রমিকদের নিয়ে কোনো কর্মসূচি আছে বলে আমাদের জানা নেই। ফলে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রমিক সর্দারদের মাধ্যমে নিষ্পেষিত হচ্ছেন কয়লাশ্রমিকরা। তারা নিজেরাও নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানেন না। আইনি সুরক্ষারও কোনো ব্যবস্থা নেই।
সারা বিশ্বের কয়লাশ্রমিকরা ‘কোল ডাস্ট পয়জনিংয়ে’র শিকার হন। ফুসফুসে ডাস্ট প্রবেশ করলে মারাত্মক ক্ষতি হয়। ডাস্ট যেন শরীরে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য বিশেষ মাস্ক ব্যবহার করা জরুরি। জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, কয়লা একধরনের ব্ল্যাক কার্বন। এর সংস্পর্শে যারা কাজ করেন, তাদের শরীরে তিন উপায়ে ক্ষতিকর ধুলো প্রবেশ করে, নিশ্বাসের সাথে, মুখ দিয়ে এবং লোমকূপ দিয়ে। এ কার্বন ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায়, যা শ্বাসকষ্টের অন্যতম কারণ। পাশাপাশি লিভার, কিডনি ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকে, কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ধীরে ধীরে মানুষকে ভয়ঙ্কর একটি পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায়। কয়লার সংস্পর্শে কয়েক বছর কাজ করলে শারীরিক সক্ষমতাও আর থাকে না। সঙ্গত কারণে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হওয়ায় কয়লাশ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা দরকার; কিন্তু মালিকপক্ষের সে দিকে কোনো খেয়াল নেই।
যেহেতু কয়লা বহনের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা জানা নেই; তাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষারও কোনো ব্যবস্থা নেই। আশা করি, প্রান্তিক এসব শ্রমজীবীর স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে আগামী মৌসুম থেকেই তাদের সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। শুধু জীবিকার জন্য কোনো নাগরিক ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকতে পারেন না।


আরো সংবাদ



premium cement