২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
বুড়িগঙ্গা রক্ষায় ডিএসসিসির প্রকল্প

আরেকটি হাতিরঝিল যেন না হয়

-

ঐতিহাসিক নগরী ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। গত প্রায় চার শ’ বছর ধরে এই সত্য আমরা জেনে এসেছি। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো কথা একটু ভিন্নভাবে জানবে। তাদের বলা হবে, একসময় ঢাকার পাশে বুড়িগঙ্গা নামে একটি নদী ছিল। কারণ বুড়িগঙ্গা এরই মধ্যে দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। ধলেশ্বরী থেকে আসা পানিপ্রবাহ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া এবং সব ধরনের বর্জ্য নদীতে ফেলায় এটিকে এখন আর নদী বলা যায় না। দূষিত ও বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে এটি। এতে যে পানি আছে, তাকে পানি বলা চলে না। এর তলদেশে পলিথিনসহ নানা আবর্জনার প্রায় আট-দশ ফুট পুরু স্তর পড়েছে। বিষাক্ত রাসায়নিকের এই তরল থেকে অবিরাম দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে নানা রকমের রোগজীবাণু। এক যুগের বেশি সময় আগে সর্বোচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বুড়িগঙ্গা নদী বাঁচাতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি রুল জারি করেও কিছু করতে পারেননি। ফলে নদীটি ভবিষ্যতে টিকে থাকবে, এমন সম্ভাবনার কথা বলা মুশকিল।
বুড়িগঙ্গা বেঁচে থাকুক এটা সবাই চাই। কিন্তু সেটি মুখে মুখে; বাস্তবে নয়। চাইলে সে রকম উদ্যোগ থাকত। সবার আগে নদীর উৎসমুখ দখলমুক্ত করে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা হতো, বর্জ্য ফেলা বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো। তারপর নদী খনন এবং প্রয়োজনীয় অন্য ব্যবস্থার বিষয়গুলো ভাবা হতো। সেসব কিছুই যেহেতু করা হয় না, তাই ধরে নেয়া যায়, এই নদীর অস্তিত্ব থাকুক বা না থাকুক তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই।
বুড়িগঙ্গাকে বলা হতো ঢাকার প্রাণ। সেটিকে আমরা ভাগাড়ে পরিণত করেছি। মাছ ও জলজপ্রাণী বসবাসের জন্য নদীর প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত পাঁচ মিলিগ্রাম বা এর বেশি পরিমাণ অক্সিজেন থাকা জরুরি। আর দ্রবীভূত হাইড্রোজেন থাকতে হবে কমপক্ষে সাত মিলিগ্রাম। বুড়িগঙ্গার পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্য। এই পানি থেকে দূষণের ক্ষতির শিকার হচ্ছেন নগরবাসী। এর ক্ষতিকর রাসায়নিক নানাভাবে ঢুকছে ঢাকাবাসীর শরীরে। কয়েক বছর আগে নদীতে খননকাজ শুরু করেও তা বন্ধ করে দেয়া হয়। এখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি বুড়িগঙ্গা নদীর আদি স্রোতধারা বা চ্যানেলের হারানো ঐতিহ্য ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ একটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে ডিএসসিসি। প্রকল্পের আওতায় নদীর পুরনো চেহারা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি দু’পাড়ের প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকা দৃষ্টিনন্দন করে তৈরি করা হবে। থাকবে চোখ জুড়ানো সবুজ উন্মুক্ত স্থান ও বিনোদন কেন্দ্র। ইতোমধ্যে হাতিরঝিলের আদলে মাস্টারপ্ল্যানের খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
কিন্তু কাজটি সহজ নয় বলেই মনে হয়। সবার জানা, নদী বাঁচাতে হলে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য উৎসমুখেরসহ সব দখলদারকে উচ্ছেদ করে নদী দখলমুক্ত করতে হবে। যত শিল্প-কারখানার বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা হয় সেগুলোর প্রত্যেকটিতে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা স্থাপন ও তার কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। নগরীর পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থাপনাও আধুনিক করতে হবে। তবে নদী খনন কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। কারণ আট ফুট পুরু পলিথিন স্তর খনন করে এটিতে প্রাণ ফিরিয়ে আনা কতটা দুরূহ তা প্রমাণিত আগের উদ্যোগ পরিত্যক্ত হওয়ায়।
এসব কাজে প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপসহ রাজনৈতিক চাপ আসবে নিশ্চিত। হাজারীবাগের ট্যানারি সাভারে সরিয়ে নিতে যে লেজেগোবরে অবস্থা হয়েছে; তাতে বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত করার কাজ কতটা সফলভাবে হবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই য্য়া। আর একটি বিষয়, কাজটি যত বড় সেই তুলনায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প যথেষ্ট নয়। এই টাকায় সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ হলেও হতে পারে। আমরা আশা করব, বুড়িগঙ্গা ঘিরে আরেকটি হাতিরঝিল তৈরির মধ্যেই যেন প্রস্তাবিত প্রকল্প আটকে না পড়ে।


আরো সংবাদ



premium cement