০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

রফতানি আয়ের ২ হাজার ৩৩৪ কোটি ডলার কোথায়?

ইপিবির হিসাবের চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রপ্তানি আয় ২৫ শতাংশ কম হয়েছে - ডয়েচে ভেলে

বাংলাদেশের রফতানি আয়ের হিসাব নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড ঘটে গেছে৷ বাংলাদেশ ব্যাংক আর রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে মিলছে না৷ ইপিবি ২০ মাসে যে হিসাব দিয়েছে তা থেকে ২ হাজার ৩৩৪ কোটি ডলারের হদিস পাচ্ছে না বালাদেশ ব্যাংক৷

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি এর আগে কখনো হয়নি৷ এর ফলে অর্থনীতির অনেক হিসাবই এখন পরিবর্তিত হয়ে যাবে৷ ব্যালেন্স অব পেমেন্টের (বিওপি) হিসাব উলটে যাবে, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টেও প্রভাব পড়বে৷ প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাবেও পরিবর্তন আসবে৷

রফতানি আয়ের হিসাব মিলছে না
ইপিবির হিসাবে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) চার হাজার ৫৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়৷ কিন্তু এখন বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ওই সময়ে রফতানি হয়েছিল ৩ হাজার ৬১৩ কোটি ডলারের৷ তাদের হিসাবে ৯৫৪ কোটি ডলারের রফতানি কম হয়েছে৷

আর বিদায়ী অর্থবছর ২০২৩-২৪ সালের প্রথম ১০ মাসে ইপিবির হিসাবে ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে৷ আর বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রফতানি হয়েছে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের৷ তাদের হিসাবে রফতানি ১ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার কম৷

বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস এবং এর আগের অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস মিলিয়ে মোট ২০ মাসে ৯ হাজার ৩১৪ কোটি ডলারের রফতানির তথ্য দিয়েছিল ইপিবি৷ আর বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বলছে, ওই ২০ মাসে রফতানি হয়েছে ৬ হাজার ৯৮০ কোটি ডলার৷

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২ হাজার ৩৩৪ কোটি ডলারের কম রফতানি হয়েছে, যা ইপিবির হিসাবের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম৷

এখন প্রশ্ন হলো, ইপিবির হিসাবের রফতানি আয় কোথায় গেল? নাকি, ইপিবি রফতানি আয় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে?

প্রভাব
ব্যালেন্স অব পেমেন্টে (বিওপি) প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ গত মার্চ পর্যন্ত বিওপিতে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি দেখানো হয়েছিল মাত্র ৪৭৪ কোটি ডলার৷ কিন্তু এপ্রিলে এসে এ ঘাটতি ১ হাজার ৮৬৯ কোটি ডলার দেখানো হয়েছে৷ এক ধাক্কায় বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় চার গুণেরও বেশি বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে রূপ নিয়েছে চলতি হিসাবের ভারসাম্য৷ মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাবে প্রায় ৫৮০ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত দেখানো হলেও এপ্রিলে এসে সেটি প্রায় ৫৭৩ কোটি ডলারের ঘাটতিতে রূপ নিয়েছে৷

তবে বিপরীত পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের ক্ষেত্রে৷ গত দুই অর্থবছরেই আর্থিক হিসাবের বড় ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক৷ আর মার্চ পর্যন্ত অর্থবছরের ৯ মাসে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি দেখানো হয়েছিল প্রায় ৯২৬ কোটি ডলার৷ কিন্তু এপ্রিলে এসে আর্থিক হিসাবে ২২৩ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত দেখানো হয়েছে৷ আর এপ্রিল শেষে বিওপির মোট ঘাটতি দেখানো হয়েছে ৫৬ কোটি ডলার৷

বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য
এই পরিস্থিতির কারণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বক্তব্য জানতে পারেনি৷ তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো: মেজবাউল হক দুই দিন আগে সংবাদমাধ্যমকে বলেন,‘রফতানির তথ্য আমরা ইপিবি থেকে পাই৷ সংস্থাটি এতদিন যে তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে, সেটির ভিত্তিতেই বিওপির হিসাবায়ন করা হয়েছে৷ ইপিবি এখন রফতানির সংশোধিত তথ্য দিয়েছে৷ এক্ষেত্রে কী ঘটেছে, সেটির ব্যাখ্যা ইপিবি দিতে পারবে৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো দায় নেই৷'

আর ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মো: আনোয়ার হোসেনকে বার বার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি৷ তিনি গত কয়েকদিন ধরে সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন বলে জানা গেছে৷

তিন কারণ
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, তিন কারণে এই পরিস্থিতি হতে পারে৷

১. কাস্টমসের মাধ্যমে যে তথ্য নিয়ে ইপিবি হিসাব দিয়েছে সেখানে তারা ওভার রিপোর্টিং করেছে৷ ১০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি দেখানো হয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে ওটা ৪ মিলিয়ন ডলারের৷ আসলে ওই পণ্য ওটা এখানে কাটিং করা হয়েছে বা পুরোটা এখানকার পণ্য নয়৷

২. আরেকটা হতে পারে যেটা এর আগে পাকিস্তানে হয়েছে৷ তা হলো রফতানি বেশি দেখিয়ে রফতানিকারকরা সাবসিডির সুবিধা নিয়েছে৷ এখানে রফতানিকারক ও কাস্টমস দুই পক্ষই আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকতে পারে৷

৩. আরেকটা হতে পারে, যে পরিমাণ রফতানি করা হয়েছে সেই পরিমাণ অর্থ দেশে আনা হয়নি৷

তিন বলেন,‘রফতানি আয় যদি দেশে আনা না হয়ে থাকে তাহলে সেটা আনা যাবে৷ কিন্তু অন্য দুই কারণে হয়ে থাকলে তো আর দেশে অর্থ আসবে না৷’

তার কথা,‘এর ফলে অর্থনীতির অনেক হিসাবই এখন পালটে যাবে৷ বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা কারেকশন শুরু করেছে৷ আরো আগে করলে ভালো হতো৷ পুরো সিনারিও পালটে যাচ্ছে৷ কারেন্ট অ্যাকাউন্ট সারপ্লাস ছিলো, সেটা হয়ে গেছে নেগেটিভ৷ ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ছিলো নেগেটিভ, সেটা হয়ে গেছে পজেটিভ৷'

ড. মনসুর বলেন,‘এইরকম পরিস্থিতি আগে কখনো দেখিনি৷ এখন অর্থনীতির অনেক হিসাব নিকাশই উলটে গেল৷ যে তথ্য উপাত্তের ওপর অর্থনীতির বিশ্লেষণ করা হতো সেই তথ্যই ঠিক নাই৷ এর এখন একটা তদন্ত হওয়া দরকার৷ এর জন্য কারা দায়ী এবং এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে কী না তা জানা দরকার৷’

‘দায়ীদের চিহ্নিত করতে হবে’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন,‘কী কারণে এরকম হয়েছে সেটা তো আমরা বলতে পারবো না৷ বাংলাদেশ ব্যাংক, ইপিবি বলতে পারবে৷ তারা তদন্ত করে দেখতে পারে৷ শুধু তদন্ত বা এখন কারেকশন করলেই হবে না৷ দায়ীদের চিহ্নিত করতে হবে৷ ভবিষ্যতে যাতে আর না হয় তার ব্যবস্থা নিতে হবে৷'

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আহমেদ বলেন, ‘তবে আমার মনে হয় রপ্তানিকারকরা তো রফতানির ওপর নগদ সহায়তা পান৷ হতে পারে সেটা বেশি পাওয়ার জন্য প্রকৃত রফতানির চেয়ে বেশি দেখিয়েছে৷ আবার বেশি দেখানোর প্রবণতাও হতে পারে৷ ক্যাশ ইনসেনটিভ, এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড থেকে অর্থ নেয়া- এই সব কারণে প্রকৃত রফতানির চেয়ে বেশি রফতানি দেখানো হতে পারে।

তার কথা,‘এতে তো এখন অনেক হিসাব বদলে যাচ্ছে৷ ব্যালেন্স অব পেমেন্ট নেগেটিভ হচ্ছে৷ আবার ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট পজেটিভ হচ্ছে৷ এর প্রভাব পড়বে ডলারের উপরে, টাকার অবমূল্যায়ন হবে৷ কম না তো ২৩-২৪ বিলিয়ন ডলারের গরমিল৷’

‘মাথাপিছু আয় কমবে’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন,‘রফতানির হিসাবে এই গরমিলের কথা আপনাদের দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আমি বেশ আগেই বলেছিলাম৷ শুধু রফতানি নয় আমদানির হিসাবেও ঝামেলা আছে৷ ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৬৮ কোটি ডলার৷ তখন আমাদের উদ্বৃত্ত ছিল ৯২৭ কোটি ডলার৷ কিন্তু পরের অর্থ বছরে আমাদের আমদানি ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়৷ ২০২১-২২ অর্থ বছরে আমদানি বাবদ ব্যয় দেখানো হলো ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলার৷ অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি আমদানি করা হয়েছে৷ বাংলাদেশে এমন কী ঘটেছে যে এক বছরে আমদানির উল্লম্ফন ঘটলো?'

তার কথা,‘অর্থনীতির সঠিক তথ্য উপাত্ত না থাকলে অর্থনীতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না৷ সঠিক পরিকল্পনা নেয়া যায় না৷ তবুও ভালো যে বাংলাদেশ ব্যাংক এর কারেকশন শুরু করেছে৷ এর ফলে আমাদের এখন জিডিপি কমে যাবে, প্রবৃদ্ধি কমবে, মাথাপিছু আয় কমবে৷ কমা বলা ঠিক হবে না৷ আগে বেশি দেখানো হয়েছে৷ এখন বাস্তব চিত্র প্রকাশ পারে৷'

ড. তিতুমীর বলেন,‘ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর পেছনে রাজনীতি আছে৷ কথিত উন্নয়ন দেখানোর প্রবণতার কথা তো পন্ডিতরা বলেন৷ কিন্তু প্রকৃত অবস্থা জানতে হলে সঠিক তথ্য উপাত্ত দরকার৷’

সূত্র : ডয়েচে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement