১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

কোমল পানীয়র বাজারে চলছে কোল্ড ওয়ার

কোমল পানীয়র বাজারে চলছে কোল্ড ওয়ার - ছবি : বিবিসি

ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করা নিয়ে বাংলাদেশে কোমল পানীয়র বাজারে এক ধরনের নীরব যুদ্ধ শুরু হয়েছে।

এই ইস্যুকে ঘিরে কোকাকোলা এবং মোজো’র মতো দুটি কোম্পানি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চালাচ্ছে পাল্টাপাল্টি প্রচার-প্রচারণা। যার প্রভাব পড়ছে এসব কোমল পানীয়র ব্যবসাতে।

গাজা যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে। এদের মধ্যে নারী এবং শিশুও রয়েছে। ফলে বিশ্বজুড়ে ইসরাইলের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন কোম্পানিকে পণ্য বয়কটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

এদিকে, বাংলাদেশের একটি পানীয় কোম্পানি মোজো গাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা করছে। অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপর একটি পানীয় কোকাকোলা বয়কট করা নিয়ে চলছে প্রচারণাও।

এরই প্রেক্ষিতে কোকাকোলা একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করেছে। যেখানে তারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক নেই এমন তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছে।

বাংলাদেশে কোকাকোলার যে অবস্থা
কোকাকোলা বিশ্বের অন্যতম পুরনো কার্বনেটেড পানীয় উৎপাদনকারী ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। কোমল পানীয় হিসেবে এটি মানুষের কাছে জনপ্রিয়।

প্রতিষ্ঠানটির একটি ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে কীভাবে ব্যবসা শুরু হয় সে সম্পর্কে বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, তাবানি বেভারেজের মাধ্যমে ঢাকায় এবং কে রাহমানের মাধ্যমে ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামে কোকাকোলা ব্যবসা শুরু করে।

১৯৮২ সালে আব্দুল মোনেম লিমিটেডের পানীয় ইউনিট কোকাকোলার ফ্রাঞ্চাইজি বোতলজাতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে এবং এখনো এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের বাজারে বোতলজাতকরণ, প্যাকেজিং, বিক্রয় এবং বিতরণের দায়িত্ব পালন করছে।

প্রতিষ্ঠানটির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেড ২০১৭ সালে ময়মনসিংহের ভালুকায় ৭৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে একটি বোতলজাতকরণ কারখানার স্থাপন করেছে।

কোকাকোলার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ১৮৮৬ সালের আটই মে ড. জন এস পিম্বারটন কোকাকোলা তৈরি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার জ্যাকব ফার্মেসিতে এটি তৈরি হয়।

ওয়েবসাইটটিতে ১৯৯০ সালে কোকাকোলা বাংলাদেশের বাজারের ৭০ শতাংশ দখল করে বলে দাবি করা হয়েছে।

তবে, গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশেষত গত কয়েক মাস ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসরাইলি পণ্য বয়কটের যে প্রচারণা চলছে তাতে এই কোকাকোলার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

ফেসবুকে কোকাকোলাকে ইসরাইলি পণ্য হিসেবে বিবেচনা করে অনেকে তা বর্জন করার আহ্বান জানাচ্ছেন। এমনকি বিকল্প হিসেবে কোন পণ্য খাওয়া যায় সেসবও উল্লেখ করে দিচ্ছেন কেউ কেউ।

এরই প্রেক্ষিতে, কোকাকোলা সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করেছে যেখানে দেখানো হয়েছে, কোক ‘ওই জায়গার’ বলে এখন আর ক্রেতা তা খেতে চাচ্ছেন না। একপর্যায়ে বিক্রেতা এ তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে যান।

যাচাই করে বিক্রেতা বলেন, কোক মোটেও ওই জায়গার না। ১৩৮ বছর ধরে ১৯০টি দেশে মানুষ কোক পান করে। তুরস্ক, স্পেন, দুবাইতেও মানুষ এ পানীয় পান করে।

এমনকি ফিলিস্তিনেও কোকের ফ্যাক্টরি আছে। এরপর বিজ্ঞাপনচিত্রটিতে ক্রেতাদের কোক কিনতে দেখানো হয়েছে।

সবশেষে বিক্রেতা বলেন, কোকে একটা ঢোক দেন, তারপর একটা সার্চ দেন।

এই বিজ্ঞাপনটি নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই ফেসবুকে চলছে ব্যাপক সমালোচনা।

বিজ্ঞাপনটিতে ‘ওই জায়গার’ বলে একটা নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি বিজ্ঞাপনটিতে বয়কটকারী বা গুজব ছড়ানোর কাজে যাদের সম্পৃক্ত দেখানো হয়েছে সেসব চরিত্রে সোহেল, সুলতান সোলেমান, বাশার ও আকাশ একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে প্রতিনিধিত্ব করে।

এমডি আহরার হোসাইন লিখেছেন, ‘কোকের অ্যাড খালি কমিউনিকেশন্স ব্যাকফায়ারের একটা নিকৃষ্ট উদাহরণই না অশ্লীলতার একটা চূড়ান্ত নজিরও। কেন অশ্লীল বলছি? ‘ওই জায়গা’ বলতে কোন জায়গা বোঝানো হয়েছে সেটা যেমন সবাই বোঝে, তেমনি ‘সুলতান সুলেমান’ বা বাশার নাম ধরে কাদের আঘাত দেয়া হচ্ছে সেটা কি কেউ বোঝে না? কোন উর্বর মস্তিষ্ক দিয়ে যে এই জিনিস বাইর হইছে?’

ফেসবুকে এমন অসংখ্য সমালোচনার পর মঙ্গলবার ইউটিউবে বিজ্ঞাপনটি আর দেখা যায়নি। তবে, বুধবার আবার এটি ইউটিউবে দেখা যায়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারণার প্রভাব এর বিক্রিতেও পড়েছে বলে বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।

ঢাকায় কোকাকোলার একজন মার্কেটিং ডেভেলপমেন্ট অফিসার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘২০২৩ সালের তুলনায় এ বছর কোকাকোলার বিক্রি ৬০ শতাংশ কমে গেছে। আমার এরিয়ায় গত বছর দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার কোক বিক্রি হয়েছিল। সেটা এখন এক থেকে দেড় কোটি টাকার মধ্যে চলে আসছে।’

কোমল পানীয় মোজোর যে অবস্থা
বাংলাদেশের কোম্পানি আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের উৎপাদিত কোমল পানীয় মোজো। ২০০৬ সালের এপ্রিলে এই পানীয়টির যাত্রা শুরু।

ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোকাকোলা বয়কটের ডাক দিয়ে দেশীয় পণ্য মোজো খাওয়ার প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এমনকি এই প্রতিষ্ঠানটিও গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ফিলিস্তিনের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ‘মোজো সাপোর্ট ফিলিস্তিন’ নামে কর্মসূচি নিয়েছে।

গত বছর থেকে মোজো বিক্রির এক টাকা করে ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের জন্য বরাদ্দ করা হয়।

এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনের অ্যাম্বাসিকে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দেড় কোটি টাকা অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে। তবে, তারা ওই অর্থ এখনো দিতে পারেনি বলে ব্যাংকেই রেখে দিয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে আকিজ গ্রুপের পক্ষ থেকে মিশরে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আসক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সরাসরি গাজার জন্য টাকা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মো: মাইদুল ইসলাম বলেন, ‘জাতিসঙ্ঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের অধীনে যে কার্যক্রম চলমান তাতে আকিজ ট্রাস্ট অর্থ সহায়তা দিয়েছে। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আসক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এ টাকা দেয়া হয়। প্রথম দফায় পাঁচ কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়।’

একইসাথে গাজার ১৫ লাখ অধিবাসীদের রমজানে খাবার দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। মোজো বিক্রি করে প্রায় দুই কোটি টাকা তহবিলে জমা পড়েছে বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি। ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠানটি সহায়তা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়, মোজোর এসব কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে কোক বয়কটের ডাক দিয়ে দেশি পণ্য মোজো খাওয়ার আহ্বান করা হচ্ছে।

ইসলাম বলেন, ‘পাইওনিয়ার হিসেবে মানবতার জন্য কাজ করছি আমরা। বিশ্বের আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। তারাও যদি এটা নিয়ে ভয়েস রেইস করে তবে আজকে গাজায় যে আগ্রাসন চলছে তা বন্ধ হবে। এই টাকা উঠলে পুনর্বাসনের জন্য হয়তোবা হেল্প হবে। অ্যাজ এ পাইওনিয়ার হিসেবে আমরা এটাকে সাকসেসফুল করার চেষ্টা করতেছি।’

বিভিন্ন এলাকায় কথা বলে জানা যায়, বাজারে বা পাড়ার বিভিন্ন দোকানে কোকের চেয়ে মোজো বা দেশীয় অন্য পণ্যের চাহিদা বেড়েছে।

পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, অতীতের তুলনায় এখন কোক বিক্রি কমে গেছে। ক্রেতারা দেশী পণ্য খোঁজ করে। যেটা আগে ছিল না। যদি দেশী পণ্য না পায় তখন কোক চায়।

তবে মোজোর সরবরাহ কম বলে মানুষ এটি পাচ্ছে না। এটি ঠিক থাকলে কোকের বিক্রি আরো কম হতো বলে জানান তারা।

কাওরান বাজারের পাইকারি বিক্রেতা মো: জুয়েল বলেন, ‘আগে দৈনিক ২০ কেইস কোক বিক্রি করতাম। এখন ১০ কেইস বিক্রি হয়। দোকানদাররা কোক কম কিনে এখন। মোজো কিনে বেশী। কিন্তু মোজোরও সাপ্লাই কম। কোম্পানি যদি ঠিকমতো দিতে পারতো তাইলে কোকের বিক্রি আরো কমে যেতো।’

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, ওই কর্মসূচির পর এ বছরের প্রথম তিন মাসে মোজোর বিক্রি বেড়েছে।

মোজোর প্রধান বিপণন কর্মকর্তা ইসলাম বলেন, ‘আগেই কোলা ইন্ডাস্ট্রিতে মোজোর ২৯ শতাংশ শেয়ার ছিল। এ বছরের প্রথম তিন মাসে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ মার্কেট শেয়ার বেড়েছে। অর্থাৎ তা ৩৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ শতাংশে।’

এখানে মার্কেট শেয়ার বলতে ইসলাম কোলা পানীয়র বাজারে মোজোর বিক্রির পরিমাণকে বুঝিয়েছেন।

তিনি জানান, এই পানীয়র বাজারে এর আগে কোকের ৪২ শতাংশ মার্কেট শেয়ার ছিল। তার দাবি, একজনের (মোজোর) বিক্রি বৃদ্ধি পেলে আরেকজনের কোকাকোলার বিক্রি কমে যাবে এটাই স্বাভাবিক।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement