১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩০, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বাজেটেরও মূল চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ

বাজেটেরও মূল চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ - ফাইল ছবি

গত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। বৃহস্পতিবার যে নতুন বাজেট পেশ হতে যাচ্ছে সেখানেও মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।

গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি গড়ে প্রায় ১০ শতাংশের মধ্যে ছিল। আর খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি।

সর্বশেষ মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তাতে দেখা যায়, মে মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এপ্রিল মাসে এটা ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। তবে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়েছে। এপ্রিলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। মে মাসে হয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হতে পারে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি (২০২৩-২৪) বাজেটে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করে পরে সেটি কমিয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল। বাস্তবতা বিবেচনা করে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য থেকে সরে আসছে সরকার। তারপরও বড় ঘাটতি আর ভর্তুকির বাজেটই হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতিই ভালো না। তার প্রতিফলন দেখা যায় মূল্যস্ফীতিতে। ব্যাংক ও আর্থিক খাত, রিজার্ভ, ডলারের দাম, বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ সব কিছুই নেতিবাচক। তাই সরকারকে উচ্চাভিলাষী বাজেট বাদ দিয়ে বাস্তবভিত্তিক বাজেট করতে হবে। প্রয়োজনে প্রবৃদ্ধির মাত্রা কম রেখে হলেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। কারণ, এর প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়ে।

সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান এই পরিস্থিতিতে বলেন, ‘গরিবের তো আনন্দ। হাশরের দিন পাবে। এখন উপোস থাকলে ক্ষতি কী? এখানে গরিবের জন্য কিছু করা হয় না। যা করা হয় সব ধনীর জন্য।’

মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ
এবারের বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাকেই মূল চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছে। তবে এই চ্যালেঞ্জে একটু ছাড় নিতে চায় সরকার। এবার মূল্যস্ফীতি শতকরা আট ভাগে রাখতে চায়। চলতি বাজেটে (২০২৩-২৪) ৬ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে এবার সেটা আট শতাংশ রাখা হচ্ছে।

এটা করতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানো এবং বাজারে নন-ইকোনমিক ফ্যাক্টর ফ্যাক্টর নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী নতুন বাজেটের বিষয়ে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখাই হবে আগামী বাজেটের মূল লক্ষ্য।’

গত ১৩ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বাজেট নিয়ে বৈঠক করেছে অর্থবিভাগ। সেখানে তিনি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। এবার বাজেটে (২০২৪-২৫) সার্বিকভাবে যা করা হচ্ছে তার টার্গেট হচ্ছে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। অর্থমন্ত্রী বলেছেন তারা এবার কোনো উচ্চাভিলাষী বাজেট করছেন না। তাই বাজেটের আকার তেমন বাড়ছে না। বাজেট ঘাটতিও কমানো হবে। কিন্তু আয় বাড়ানোর জন্য বাড়বে করের বোঝা।

জানা গেছে, নিত্য প্রয়োজনীয় ও নিত্য ব্যবহার্য অনেক পণ্যের ওপর কর বাড়তে পারে। তবে আয়কর বাড়ছে না। করমুক্ত আয়সীমাও গত বাজেটের মতো তিন লাখ টাকাই থাকছে। তবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে নির্ধারিত হারে কর দিয়ে।

দেশের অর্থনীতি এখন নানা চাপে আছে। এরমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমা থামানো যাচ্ছে না। ডলারের দাম বাড়িয়ে অনেকটা বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়ায় ঢাকার আরো অবমূল্যায়ন হয়েছে। রফতানি আয় নিয়ে সঙ্কট আছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে না। বাড়ছে না কর্মসংস্থান। আর আর্থিক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা যায়নি।

বাজেটের আকার
অর্থমন্ত্রী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের যে বাজেট বৃহস্পতিবার সংসদে উপস্থাপন করবেন তার আকার হবে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার। চলতি অর্থবছরের চেয়ে এটা ৩৬ হাজার কোটি টাকা বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল সাত লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা।

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। এনবিআর কখনোই লক্ষ্যমাত্রার রাজস্ব আদায় করতে পারেনি। তারপরও এই রাজস্ব আদায় হলেও দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে। ঘাটতি পূরণে সরকার ঋণ নিতে চায় অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ও বৈদেশিক খাত থেকে।

বাজেটে অর্থের জোগান দিতে সরকারকে এখন আগের চেয়ে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে। ফলে বাড়ছে ঋণ পরিশোধের চাপ। ডলার সঙ্কট ও ডলারের বাড়তি দাম সরকারকে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে আরো বেশি চাপে ফেলেছে। আগামী অর্থবছরের জন্য সুদ পরিশোধে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম হলো ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। সেজন্য তিনি দেশের অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করতে চান দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা সম্পদ আহরণের চ্যালেঞ্জে আছি। জিডিপি অনুসারে আমাদের রাজস্ব আদায় হলো উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। এখন এটা বাড়াতে গিয়ে যদি পরোক্ষ কর (ভ্যাট) বাড়ানো হয় তাহলে তার চাপ তো সাধারণ মানুষের ওপর পড়বে। প্রত্যক্ষ কর (আয় কর), সেটা আদায় বাড়াতে হবে। ট্যাক্স নেট বাড়াতে হবে। এনবিআরকে দক্ষ করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘বাজেটে ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণ এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভর করা হচ্ছে। ফলে এর চাপ দিন দিন বাড়ছে। বাজেটের একটা বড় অংশ আবার ওই খাতে ঋণ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে। ফলে আমাদের সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই।’

তার কথা, ‘দেশী বিদেশী দুই ধরনের বিনিয়োগই কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব আবার পড়ে কর্মসংস্থানের ওপর। সুদের হার বেশি হওয়ায় শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যে এক ধরনের মন্দা। সরকার এটা কীভাবে মোকাবেলা করবে বাজেটে সেটা দেখার বিষয় আছে।’

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আর মূল্যস্ফীতিকে সবার ওপরে গুরুত্ব দিতে হবে। এটা কমিয়ে আনতে না পারলে সার্বিকভাবে পরিস্থিতি খারাপ থাকবে। এরজন্য প্রয়োজন হলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে এনে বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।’

তার কথা, ‘অযথাই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়। এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হয়। আর এই সুযোগ দিয়ে কোনো লাভ হয়। খুব বেশি যে কালো টাকা সাদা হয় তাও নয়। আমরা মনে করি এটা অনৈতিক।’

বাজেটকে সুশাসনের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করা জরুরি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

রাজস্ব বাড়ানোর তাগিদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ‘সার্বিকভাবে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই চ্যালেঞ্জ। ব্যাংকিং সেক্টর, শেয়ারবাজার সবকিছু মিলে একটা অস্থিতিশীল অবস্থা চলছে। এর প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। এগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য সর্বোপরি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এটা শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে সম্ভব নয়।’

তিনি বলেন, ‘আর রিজার্ভের ওপর চাপ। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় টাকার অবমূল্যায়ন। এগুলো ঠিক না রাখতে পাড়লে রফতানি বাড়বে না। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা দরকার।’

তার কথা, ‘রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে হবে না। আর আমাদের খরচ কমাতে হবে। অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। এবারও দেখলাম এই খাতে অনেক বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। সার্বিকভাবে সরকারকে একদম হিসাবনিকাশ করে একটি কমপ্যাক্ট বাজেট করতে হবে। এখানে উচ্চাভিলাষের কোনো জায়গা নেই। অভ্যন্তরীণ সম্পদ না বাড়িয়ে বাইরে থেকে ঋণ এনে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না।’

‘গরিব পাবে হাশরের দিন'
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আশা করি এবার বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর সুনির্দিষ্ট নীতি থাকবে। তবে এই পরিস্থিতিতে সরকার এক কোটি পরিবারকে যে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে তা দেড় কোটি টাকা করা প্রয়োজন।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কালো বলে কোনো টাকা নাই। সব আমার টাকা। ওই টাকা দেশে রাখতে হবে। সাবেক আইজিপি বেনজির সাহেব এয়ারপোর্ট থেকে চলে গেল। সে কি মাছি নাকি যে এয়ারপোর্ট থেকে চলে যাবে! গরিবের জন্য আইন, ধনীর জন্য কোনো আইন নাই। দেশের গরিবদের অবস্থা খারাপ। গ্রামের গরিবদের অবস্থা আরো খারাপ। এটা ধনীদের লুটপাটের দেশ।’

তার কথা, ‘গরিবের তো আনন্দ। হাশরের দিন পাবে। এখন উপোস থাকলে ক্ষতি কী? এখানে গরিবের জন্য কিছু করা হয় না, যা করা হয় সব ধনীর জন্য।’

সূত্র : ডয়চে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement