ধানচাষ থেকে সরে আসছেন কৃষক
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ১১ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৪১, আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৪২
দেশে কৃষি খাতের উন্নয়ন হলেও কৃষকের উন্নতি হয়নি। ধান চাষে লাভবান না হওয়ায় ধানের উৎপাদন ক্রমাগত কমছে । কৃষক ধান চাষ থেকে সরে আসছেন। অন্য দিকে সরকারের ধান-চাল মজুদ করার সক্ষমতা কম হওয়ার কারণে বেশির ভাগ সময়ই সরকারের পক্ষে বাজার প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে না। সরকারের বর্তমান খাদ্যশস্য মজুদ পর্যাপ্ত নয় এবং এটি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
এসব মন্তব্য উঠে আসে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আয়োজিত ‘চালের দাম বাড়ছে কেন? কার লাভ, কার ক্ষতি’ শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল সংলাপে। গতকাল রোববার এই সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এতে বক্তারা বলেন, কৃষি উৎপাদনের প্রাক্কলনেও সমস্যা রয়েছে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে রক্ষা করাই এই খাতে মূল চ্যালেঞ্জ। আগামী বোরো ধান চাষের পরবর্তী সময়ে খাদ্য পরিস্থিতিকে নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। বর্তমানে চালের বাড়তি দাম যেন উৎপাদকের কাছে পৌঁছাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্য দিকে চালের দাম যেন নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি না করে তা খেয়াল রাখতে হবে। কৃষক, কৃষি খাতের সাথে যুক্ত সবপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘কৃষিপণ্য মূল্য কমিশনে’র প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্ষেপণ এবং স্বল্প-মধ্যমেয়াদে দাম নির্ধারণ করা সহজ হবে। এই কমিশনের মাধ্যমে বাজার সঙ্কেত পাবে, নীতিনির্ধারকরা পদক্ষেপ নিতে পারবে এবং গবেষণাকে কার্যকরভাবে উৎপাদনের সাথে যুক্ত করা যাবে।
এসডিজি প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সংলাপে সভাপতিত্ব করেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধান উৎপাদনের সঠিক প্রাক্কলনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই প্রাক্কলনের ওপর ভিত্তি করেই নীতিনির্ধারকরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তিনি আরো বলেন যে, সরকারের ধান-চাল মজুদ করার সক্ষমতা কম হওয়ার কারণে বেশির ভাগ সময়ই সরকারের পক্ষে বাজার প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে না। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন যে ছোট ও মাঝারি কৃষকের টিকে থাকার সক্ষমতা কম, তাই তাদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
দেশের উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল ও হাওর অঞ্চলের মোট ৯টি জেলা (গাইবান্ধা, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, মেহেরপুর, নীলফামারী, রংপুর, সিরাজগঞ্জ ও কুড়িগ্রাম) থেকে প্রায় ৪০ জন কৃষক, কৃষাণী এবং কৃষি ব্যবসার সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ এই সংলাপে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা বলেন, মিল মালিকরা আগেই ধান কিনে মজুদ করে রাখে, যে কারণে চালের দাম বাড়লেও কৃষক তার মূল্য পায় না। ধান চাষে খরচের তুলনায় কম দামে বিক্রি করতে হয়, তাই কৃষক ধান চাষ থেকে সরে আসছেন। তারা আরো বলেন, সরকার যে ধান সংগ্রহ করেন সেখানে সবাই অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তাই কম দামে মিল মালিকের কাছে বিক্রি করতে হয়।
সংসদের কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য মুহাম্মদ ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক কৃষি খাতে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন ভর্তুকি ও উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন এবং বলেন যে এসব সুবিধা কৃষকপর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকার বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে।
ধান চাষে লাভবান না হওয়ায় ধানের উৎপাদন ক্রমাগত কমছে বলে মনে করেন চ্যানেল আইর পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ। তিনি বলেন, কৃষি খাতে অনেকে ধান চাষ থেকে উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় এবং চাষযোগ্য জমি কমে আসায় ধান চাষের ক্ষেত্রে সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারি গুদামে ছোট কৃষকদের ফসল সংরক্ষণ করার সুযোগ করে দিতে হবে যেন ফসল ওঠার সাথে সাথে কৃষককে অল্প দামে ফসল বিক্রি না করতে হয়।
বাজারে চালের দাম বাড়লেও এই বাড়তি দামের কারণে কৃষক লাভবান হয় না বলে মনে করেন ড. এম আসাদুজ্জামান, সাবেক গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআইডিএস)। তিনি বলেন, কৃষক অনেক আগেই কম দামে ধান বিক্রি করে দেয়। একই প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক কাজী শাহাবুদ্দিন বলেন, সরকারের বর্তমানে খাদ্যশস্য মজুদ পর্যাপ্ত নয় এবং এটি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি। বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, সরকার প্রকৃত কৃষকের থেকে চাল না কিনে মিলারদের থেকে ক্রয় করছে, তাই কৃষক উপকৃত হচ্ছে না। মিলারদের ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মজুদদারির কারণে বাজারে চালের অপর্যাপ্ততার কথা তুলে তিনি বলেন যে, প্রতি বছর বাম্পার ফলনের পরেও চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। সরকারকে স্থানীয় পর্যায়ে ক্রয়কেন্দ্র করে সরাসরি কৃষক থেকে চাল ক্রয় করার পরামর্শ দেন তিনি। বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম খান বলেন, মিলাররা মৌসুমের শুরু থেকেই কৃষকদের থেকে ১,০৫০ টাকায় ধান ক্রয় করেছে। চালের এই বাম্পার ফলনের কথার সাথে দ্বিমত করে তিনি বলেন যেÑ এই মৌসুমের শুরু থেকেই সরবরাহ কম ছিল।
বাজারে চালের পর্যাপ্ততা নিয়ে বাংলাদেশ রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ আলম বাবু বলেন, চালের আমদানি শুল্ক কমানো হলেও সঠিক সময়ে এই নীতি গ্রহণ না করায় সেই পরিমাণ চাল আমদানি করা যায়নি। ধান ও চালের তথ্য বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো: শাহজাহান কবির উৎপাদনের ভুল প্রাক্কলন নিয়ে সংলাপে উপস্থিত বক্তাদের মন্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন- উৎপাদনের প্রাক্কলন সঠিক ছিল এবং তিনি খাদ্য সঙ্কটের সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন না।
সংলাপে ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম মহাপরিচালক বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এবং ড. মো: নাজিরুল ইসলাম মহাপরিচালক বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটও বক্তব্য রাখেন।