অপসারিত ব্যক্তির সম্পত্তি জব্দের ক্ষমতা পাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
- সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু
- ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৪১
আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংক থেকে অপসারিত ব্যক্তির ব্যক্তিগত হিসাব অবরুদ্ধ, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ এবং ক্ষেত্রমতো বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। বিদ্যমান ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১’ সংশোধন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এই ক্ষমতা প্রদান করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বিদ্যমান আইনে ‘জনস্বার্থে’ বাংলাদেশ কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী (এমডি) অপসারণ করার যে ক্ষমতা রয়েছে তার আওতাকে আরও বাড়ানোর হচ্ছে।
ফলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী ছাড়াও আগামীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘জনস্বার্থে’ চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা তার নিম্নতর দুই স্তর পর্যন্ত কর্মকর্তাকেও অপসারণ করতে পারবে। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক অনিয়মের কারণে দুর্বল ব্যাংককে জনস্বার্থে অবসায়ন ও একীভূতকরণও করতে পারবে।
আইনের সংশোধনীতে ব্যাংক পরিচালকদের অর্ধেকের বেশি ব্যাংকিং, হিসাববিজ্ঞান, ফাইন্যান্স, অর্থনীতি, কৃষি ও গ্রামীণ অর্র্থনীতি, ক্ষুদ্র ও কুঠিরশিল্প, আইসিটি ও অন্যান্য এক বা একাধিক বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পেশাদার জ্ঞান ও বাস্তবসম্মত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কোনো ব্যাংক ঋণের আসল বা মূল ঋণ মওকুফ করতে পারবে না।
এর পাশাপাশি সংশোধিত এই আইনের আওতায় প্রত্যেক ব্যাংকে স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করার জন্য দু’টি করে কমিটি গঠন এবং স্বেচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণের কথা বলা হয়েছে। একই সাথে স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিদের তালিকা ছবিসহ ব্যাংকের ওয়েবসাইট ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করার নির্দেশনা থাকছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি নীতি বিভাগ’ থেকে বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ সংযোজন, সংশোধন ও পরিমার্জন করে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সংশোধনের পর এই আইনটি বিদ্যমান আইনের মতো ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ থেকে কার্যকর রয়েছে বলে উল্লেখ করা হবে। বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে ‘স্বেচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ বিষয়ে কিছু উল্লেখ ছিল না। কিন্তু আইন সংশোধন করে স্বেচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
বলা হয়েছে, এরূপ কোনো দেনাদার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি যে নিজের বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদত্ত অগ্রিম, ঋণ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ বা এর ওপর অর্জিত সুদ বা এর মুনাফা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী স্বেচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা বলে গণ্য হবে।
এ ক্ষেত্রে নির্ধারণ করা চার শর্তের মধ্যে রয়েছে, (১) যদি তার ঋণ পরিশোধ করার জন্য আর্থিক সচ্ছলতা বা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, অথবা (২) জাল-জালিয়াতি, প্রতারণা ও মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে অস্তিত্ববিহীন কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির নামে ঋণ গ্রহণ করে, অথবা (৩) তাকে যে উদ্দেশ্যে ঋণ প্রদান করা হয়েছিল সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে ঋণের অর্থ অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে অথবা স্থানান্তর (পাচার) করে, অথবা (৪) ঋণ বা অগ্রিমের বিপরীতে প্রদত্ত জামানত ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক কোম্পানির অজ্ঞাতে হস্তান্তর বা স্থানান্তর করে।
বিদ্যমান আইনে পরিবারের সংজ্ঞা দেয়া ছিল নাম, সংশোধিত আইনে পরিবারের ‘শ্বশুর-শাশুড়ি’-কে অন্তর্ভুক্ত করে পরিবার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘পরিবার অর্থ কোন ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন, পুত্রবধূ, কন্যার জামাতা, শ্বশুর, শাশুড়ি, নাতি-নাতনী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল সকলকে বুঝাবে।’
সংশোধিত আইনে পরিচালকদের শেয়ার ক্রয়ের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরওপ করা হয়েছে। সংশোধিত ধারা ১৪ক তে বলা হয়েছে, (১) কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোম্পানি বা তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি, একই গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি কিংবা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্য ব্যাংকের শেয়ার কেন্দ্রীভূত করা যাবে না এবং কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা তাহার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি, একই গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি, পৃথক সত্তা থাকা সত্ত্বেও, কিংবা একই পরিবারের সদস্য একক, যৌথ বা উভয়ভাবে কোন ব্যাংকের শতকরা দশ ভাগের বেশি শেয়ার ক্রয় করবেন না। এই আইন কার্যকর হওয়ার দুই বছরের মধ্যে এই উপ-ধারার বিধান মোতাবেক শেয়ার ধারণ সংরণ নিশ্চিত করতে হবে।
ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৫৮ক এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যাংক মনে করে যে, তার তারল্য, সম্পদের গুণগত মান ও মূলধন পরিস্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত হারে ও পন্থায় তারল্য, সম্পদ ও মূলধন সংরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি এর অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হবে তা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করবে।
উপধারা (ঘ) এ বলা হয়েছে, জনস্বার্থে ও দেশের সামগ্রিক অর্থব্যবস্থার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই ব্যাংকের পুনর্গঠন বা ত্রেবিশেষে অবসায়ন করতে পারবে। এ ছাড়া ৫৮(খ) ও ৬৯(১) ধারা মোতাবেক অন্য ব্যাংকের সাথে একত্রীকরণ করতে পারবে। ব্যাংকের দুর্বলতার জন্য দায়ীদের ক্ষেত্রে আইনে ফৌজদারি মামলা, অপসারণ এবং শেয়ার বাজেয়াপ্তের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক হিসাব জব্দ এবং আদালতের আদেশ নিয়ে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এই আইন কার্যকর হবার পর কোন ব্যাংক কোম্পানিতে স্বতন্ত্র পরিচালকসহ সর্বনিম্ন ১১ জন হবেন এবং সর্বমোট ২০ জনের অধিক পরিচালক থাকবেন না। তবে শর্ত থাকবে যে, কোন ব্যাংক কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক সংখ্যা হবে মোট পরিচালক সংখ্যার অন্যুন এক-পঞ্চমাংশ এবং ভগ্নাংশ হলে পরবর্তী পূর্ণ সংখ্যা হিসাবায়ন করতে হবে।
এখানে আরো শর্ত রাখা হয় যে, স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের পূর্বে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে এবং আইন কার্যকর হবার ৩ বছরের মধ্যে এই উপ ধারার বিধান মোতাবেক স্বতন্ত্র পরিচালকগণের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
আইনে বলা হয়েছে, প্রত্যেক ব্যাংক কোম্পানি পরিচালনা পর্র্ষদের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি এর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করবে এবং প্রত্যেক ব্যাংক কোম্পানি উহার পর্ষদ সদস্যদের সমন্বয়ে একটি নমিনেশন ও রেমুনারেশন কমিটি গঠন করবে। এ ছাড়া প্রত্যেক ব্যাংক কোম্পানি তার পরিচালনা পর্র্ষদের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি এথিকস ও কমপ্লায়েন্স কমিটি গঠন করবে।
আইনের ২৭ক ধারার বিশেষ বিধানে বলা হয়েছে, ‘স্বেচ্ছাকৃত/ ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের ক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এর মধ্যে রয়েছে, (১) তালিকাভুক্ত স্বেচ্ছাকৃত/ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের অনুকূলে কোন ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনরূপ ঋণ বা আর্থিক সুবিধা প্রদান করতে পারবে না। (২) স্বেচ্ছাকৃত/ইচ্ছাকৃত খেলাপি খণ গ্রহীতার তালিকাভুক্তির ১ মাসের মধ্যে বন্ধকীকৃত সম্পত্তির দখল ও বিক্রয়ের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
(৩) স্বেচ্ছাকৃত/ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্যদের অনুমোদনক্রমে ফৌজদারি মোকদ্দমা দায়ের করবে। (৪) স্বেচ্ছাকৃত/ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিলেন বা থাকেন এরূপ ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান কোন ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হওয়াও যোগ্য হবেন না।
(৫) স্বেচ্ছাকৃত/ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিকট প্রেরণপূর্বক তাদের বিজনেস কাসে বিদেশ ভ্রমণ গাড়ি ও বাড়ি রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যান্ড ফার্মসের (আরজেএসসি) কোম্পানি নিবন্ধনের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরওপের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
স্বেচ্ছাকৃত/ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে বয়কট করার জন্য রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সম্মাননা প্রদান ও অনুষ্ঠানের নীতিমালা করার সময় ঋণ খেলাপের বিষয়টি বিবেচনা করবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা