২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভারতীয় বিদ্যুৎনির্ভর হচ্ছে বাংলাদেশ

ভারতীয় বিদ্যুৎনির্ভর হচ্ছে বাংলাদেশ - ছবি : সংগৃহীত

ভারতীয় বিদ্যুৎনির্ভর হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রথম বহরমপুর, এরপর ত্রিপুরার পালাতানা, এখন ঝাড়খণ্ড থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করবে সরকার। কুষ্টিয়া, দক্ষিণ কুমিল্লা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ এই তিন অঞ্চল দিয়ে বিদ্যুৎ আনা হবে। এই তিন সাইট দিয়ে মোট আমদানি হবে ২ হাজার ৯৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, যা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। ইতোমধ্যে বহরমপুর থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়েছে। ঝাড়খণ্ড দিয়ে আমদানির জন্য ২৮ কিলোমিটার ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালনলাইন নির্মাণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এর জন্য ব্যয় হবে ২২৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। আগামী মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পেশ করা হচ্ছে বলে একনেক সূত্রে জানা গেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গড্ডা জেলায় আদানি পাওয়ার লিমিটেড ২ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কোল ফায়ার্ড থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করছে। ওই প্ল্যান্ট থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই বিদ্যুৎ রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলসহ ঢাকার বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করবে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন একটি প্রকল্পের আওতায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহসপুর থেকে বগুড়া পর্যন্ত ১০৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ৪০০ কেভি সঞ্চালনলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ওই গ্রিডের সাথে ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংযোগ স্থাপন করবে। আর এ জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর ইউনিয়ন থেকে একই জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়ন (সীমান্তবর্তী) পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালনলাইন নির্মাণ করতে যাচ্ছে। তিন বছর মেয়াদে এই লাইন নির্মাণ করা হবে। আগামী ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার কথা। প্রকল্পটি চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত প্রকল্পের তালিকায় রয়েছে।

প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, আদানি পাওয়ার (ঝাড়খণ্ড) লিমিটেড (এপিজেএল) থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাপারে গত ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পিজিসিবি এবং ভারতের এপিজেএলের মধ্যে বিদ্যুৎ ক্রয় সম্মতি (পিপিএ) এবং বাস্তবায়ন সম্মতি (আইএ) স্বাক্ষরিত হয়। ওই সম্মতি চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ২০২২ সালের জানুয়ারি ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়ার ইভেকুয়েশন শুরু করতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর ছয় মাস আগে ব্যাক ফিড পাওয়ার সরবরাহ করতে হবে। ওই লাইনের ফলে জাতীয় গ্রিডে আরো ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

ব্যয় বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, ঝাড়খণ্ড থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ২৮ কিলোমিটার লাইন নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৫ কোটি ৭১ লাখ ৪২ হাজার টাকা। ত্রিপুরা থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে প্রতি কিলোমিটার লাইন নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

জানা গেছে, ভারত থেকে ভেড়ামারা দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য ২০১০ সালে আন্তঃসংযোগ গ্রিড লাইন নির্মাণে কাজ শুরু করা হয়। এই প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ৯১০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়। এই গ্রিড লাইন স্থাপনে ব্যয় হয় ১ হাজার ৫৭৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের জুনে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এরপরই ভারত থেকে বিদ্যুৎ ৫০০ মেগাওয়াট আমদানি শুরু করা হয়। এরপর বাড়তি ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য গ্রিড সংযোগের ক্ষমতা ১ হাজার করার জন্য ২০১৫ সালের জানুয়ারি প্রকল্প নেয়া হয়। ২০১৮ সালের জুনে সমাপ্ত করার জন্য ব্যয় অনুমোদন দেয়া হয় ১ হাজার ৪০৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এখানেও এডিবি থেকে ৮৪৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ঋণ নেয়া হয়। এক বছর না যেতেই প্রকল্প ব্যয় ৪৭৩ কোটি টাকা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবি)। বহরমপুর দিয়ে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনতে গিয়ে পুরো বাংলাদেশ ১৩ ঘণ্টা অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তারপরেও সরকার আবার ভারতের ত্রিপুরার পালাতানা থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্পের আওতায় ত্রিপুরা থেকে দক্ষিণ কুমিল্লার উপকেন্দ্র পর্যন্ত ৪৩ কিলোমিটার সঞ্চালনলাইন নির্মাণ করা। এর মধ্যে ৪০০ কেভির ২৭ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট এবং ১৩২ কেভির ১৬ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন।

উল্লেখ্য, বহরমপুর-ভেড়ামারা বিদ্যুৎ প্রকল্পটির বিপরীতে ভারতীয় ঋণে ১৫ কোটি ৮৬ হাজার ডলারের একটি ঋণ বরাদ্দ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারত সে টাকা না দেয়ায় বাংলাদেশকে ১ হাজার ৪১ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণ নিতে হয়। এডিবির সাথে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে গত ১৩ অক্টোবর ১০ কোটি মার্কিন ডলারের বা ৭০০ কোটি টাকার ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত সুকৌশলে বাংলাদেশকে তাদের বিদ্যুতের বাজারে পরিণত করছে। তারই অংশ হিসেবে একের পর এক বিভিন্ন অঞ্চল দিয়ে তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করছে। প্রথমে বহরমপুর এবং পরে ত্রিপুরা, এখন ঝাড়খণ্ড থেকে বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এবার বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে সঞ্চালনলাইন নির্মাণ করে এই বিদ্যুৎ আমদানি হবে। প্রথমে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য লাইন নির্মাণে সরকার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণ নেয়। যেটা ভারতের দেয়ার কথা ছিল।

বিদ্যুৎ বিভাগের গতকাল পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ১৩ হাজার ৩০৬ মেগাওয়াট। কিন্তু চাহিদা সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট দৈনিক। গত ১৪ সেপ্টেম্বর জেনারেল বা উৎপাদন ছিল ৯ হাজার ২১০ মেগাওয়াট থেকে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৩৮ মেগাওয়াট। ওই তথ্যানুযায়ী ভারত থেকে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট আমদানি হলে তা হবে মোট উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশ।


আরো সংবাদ



premium cement