০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪২৩১, ৬ শাবান ১৪৪৬
`

বন্ধ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি থামাতে উদ্যোগ নেয়া হবে কবে

- ছবি : ইউএনবি

খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড (কেপিপিএল) প্রায় তিন বছর ধরে কোম্পানিটির কারখানা ও প্রধান কার্যালয় বন্ধ থাকালেও পুঁজিবাজারে এই কোম্পানির শেয়ারের রমরমা লেনদেন হচ্ছে, যা রীতিমতো বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) হিসাব বলছে, গত এক বছরে কোনো ধরনের উৎপাদন না হওয়ার পরও মাত্র সাত টাকায় থাকা কেপিপিএলের শেয়ারের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ৫৯ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। বর্তমানে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ৩০ টাকার ওপরে।

ডিএসসির ওয়েবসাইট ঘেটে দেখা যায়, কোম্পানিটির নিজস্ব নামের কোনো ওয়েবসাইট নেই। লকপুর গ্রুপ নামে যে ওয়েবসাইটের ঠিকানা দেয়া আছে সেটিও বর্তমানে অকার্যকর। এছাড়া কোম্পানিটিতে যোগাযোগের যেসব নম্বর দেয়া হয়েছে তার সবকটিই বন্ধ, নেই কোনো কোম্পানি প্রতিনিধির নাম কিংবা মোবাইল নম্বরও।

সরেজমিনে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার লকপুরে অবস্থিত প্রধান কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বহুদিন ধরে লকপুরের আওতাধীন বেশিভাগ কোম্পানি বন্ধ আছে।

কোম্পানিটির চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন লকপুরের পাশাপাশি ছিলেন সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ২০১৩-২১ সাল পর্যন্ত ব্যাংকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে বন্ড জালিয়াতি ও অর্থপাচারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ আনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরবর্তীতে ২০২১ সালে সেপ্টেম্বরে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি।

২০২১ সালের মার্চে আমজাদ হোসেন ও তার স্ত্রী-কন্যার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এতে লকপুর গ্রুপের আওতাধীন ধুঁকতে থাকা এ কোম্পানিটি ২০২১ সালেই কার্যত বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।

কোম্পানিটির সাবেক কর্মীরা জানান কেপিপিএলে হিমায়িত মাছ ও খাবারের মোড়কজাত করা হতো। শুধু কেপিপিএল নয়, লকপুর গ্রুপের আরেক প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠান বাংলা‌দেশ প‌লি প্রিন্টিং ইন্টারন্যাশনালও বন্ধ হয়ে গেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দায়িত্বশীল কাউকে না পাওয়া গেলেও লকপুর গ্রুপের সাবেক কর্মী হাবিবুর রহমান জানান, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় লকপুরের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে। তবে বর্তমানে এই গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠানেই কোনো ধরনের উৎপাদন হচ্ছে না। শুরুতে ২৫০ থেকে ৩০০-এর মতো কর্মী ছিল কেপিপিএলে, তবে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি একেবারেই বন্ধ।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডিএসইর প্রতিনিধিদল খুলনার রূপসায় কেপিপিএলের কারখানা পরিদর্শন শেষে জানায়, প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন বন্ধ আছে। অথচ, উৎপাদন বন্ধ থাকার পরও প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার হয়ে ওঠে কারসাজিকারকদের প্রিয় মাধ্যম। গত এক মাসের হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৩৫০ শতাংশের বেশি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মতিঝিল এলাকার এক ব্রোকারেজ হাউজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘এবারই প্রথম নয়, এর আগেও কেপিপিএলের শেয়ার নিয়ে কারসাজিকারকরা বড় রকমের মুনাফা তুলে নিয়েছে। বর্তমানে ডিএসইর সফটওয়্যারের দুর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছে একটি চক্র। কিন্তু এক্ষেত্রে ডিএসই শুধু চিঠি কিংবা সতর্কবার্তা দিয়েই চুপ থাকছে।’

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সর্বশেষ মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) কেপিপিএলের অস্বাভাবিক শেয়াদরের কারণ তদন্তের নির্দেশ দিয়ে ডিএসইকে চিঠি দিয়েছে।

একই দিনে ডিএসই জানায়, গত ২ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক লেনদেনের কারণ জানতে চেয়ে কেপিপিএলকে চিঠি দেয়া হলেও কোনো জবাব আসেনি।

এত কিছুর পরও কেন বিএসইসি শক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে না-এমন প্রশ্নে কমিশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, ‘কোম্পানির ব্যাপারে কমিশন সরাসরি নির্দেশনা দিতে পারলেও ডিএসইর উচিত নিজেদের মতো করে পুরো ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা। এ ব্যাপারে এক্সচেঞ্জের সহায়তা লাগলে বিএসইসি প্রস্তুত আছে।’

বিনিয়োগকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে যারা বিনিয়োগ করছেন তারা প্রায় সবাই জানেন যে, কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ এবং এর শেয়ার কেনাবেচা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু বাজারে তারল্য সঙ্কট থাকায় এবং এত দিনের লোকসানের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে জেনে শুনেই ঝুঁকি নিচ্ছেন তারা।

তারেক হোসেন নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘শেয়ার ভালো নাকি খারাপ, সেটি বিনিয়োগকারীরা জানলেও সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় ভুল করেন। কিন্তু কমিশন বা এক্সচেঞ্জ হাউজ জেনে-শুনে কেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কেন খারাপ কোম্পানি তালিকা থেকে বের করে দেয় না-সেটিই বড় প্রশ্ন।’

উৎপাদনে থাকার সময়ও কেপিপিএল লোকসানি কোম্পানি ছিল। কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে কোম্পানিটি সাত কোটি ৯২ লাখ টাকা লোকসান করে। পরে ২০২০ সালে ছয় কোটি টাকা লাভ হলেও, ২০২১ সালে লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ কোটি টাকায়। কোম্পানিটির দেয়া সর্বশেষ ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, মোট লোকসানের পরিমাণ ছিল দুই কোটি ৩১ লাখ টাকা।

২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটি ২০২০ সালে বিনিয়োগকারীদের সর্বশেষ লভ্যাংশ দেয় শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ।

এত বছর লভ্যাংশ না দেয়া একটি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রাখার যৌক্তিকতার প্রশ্ন তুলে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘একটি কোম্পানি ছয় মাসের বেশি উৎপাদনে না থাকলে তাকে তালিকাভুক্ত রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। অথচ বছরের পর বছর ধরে কেপিপিএলের উৎপাদন বন্ধ, অন্যদিকে এই কোম্পানির শেয়ার নিয়ে বাজারে চলছে কারসাজি। এখানে ডিএসইর উচিত, সরেজমিনে তদন্ত করে কোম্পানিটিকে পুঁজিবাজার থেকে বের করে দেয়া। কেপিপিএলের মতো কোম্পানি বাজারে রাখা মানে কারসাজিকারকদের প্রশ্রয় দেয়া।’

কেন কেপিপিএলকে পুঁজিবাজার থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে না?- জবাবে কমিশনের প্রসঙ্গ টেনে ডিএসইর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘এর আগে বেশ কয়েকবার কোম্পানিটি ডিলিস্টিং (নিবন্ধন বাতিল) করার পরও কমিশনের চাপে পুনরায় লিস্টিং (তালিকাভুক্ত) করতে হয়েছে। সে সময়ে ডিলিস্টিং নিয়মতান্ত্রিক হয়নি- এমন যুক্তিতে ক্ষতিকারক এসব কোম্পানিকে আবারো বাজারে জায়গা দেয়া হয়। এরপর থেকে এক্সচেঞ্জ হাউজ এসব ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ কমিয়ে দিয়েছে।’

বাজারে বাজে কোম্পানির প্রাদুর্ভাব নিয়ে ডিএসই পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ‘গত এক দশকে বাজারে ভালো কোনো আইপিও আসেনি। ফলে বাজে কোম্পানির প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। এসব কোম্পানিকে পুঁজি করেই কারসাজিকারকরা নিজেদের ফায়দা লুটছে।’

তিনি বলেন, ‘চাইলেই স্কয়ার, এসিআই কিংবা ভালো কোনো কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা সম্ভব নয়। কিন্তু কেপিপিলের মতো ভুঁইফোড় এসব কোম্পানি বাজার অস্থিতিশীল করছে, বিপদে ফেলছে বিনিয়োগকারীদের।’

কোম্পানিটির ২০২২ সালের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কেপিপিএলের মূল শেয়ারের প্রায় ৬০ শতাংশই আছে বিনিয়োগকারীদের হাতে। বাকি ৩৯ শতাংশ কোম্পানির পরিচালক এবং এক শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার। এ অবস্থায় পুঁজিবাজার থেকে কেপিপিএলের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে বাইব্যাক আইন চালু করার দাবি জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

ডিএসই জানিয়েছে, এক্সচেঞ্জ হাউজের রেগুলেটরি বিভাগ গুরুত্বসহকারে ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করছে। টানা কারসাজি আর ভরাডুবির পর নতুন কোনো অনিয়ম প্রশ্রয় দেয়ার সুযোগ নেই। সূত্র : ইউএনবি


আরো সংবাদ



premium cement