চ্যালেঞ্জের মুখে লাখো মানুষের পছন্দের ট্রেনসেবা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:২২
চট্টগ্রামের বাসিন্দা শহিদুর রহমান। প্রায়ই ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে যেতে হয়, কারণ তার পরিবার বন্দর নগরীতে থাকেন। নিয়মিত ভ্রমণে তার পছন্দের মাধ্যম হিসেবে সব সময়েই থাকে ট্রেন।
শহিদুর ট্রেন ভ্রমণের জন্য তার আগ্রহ প্রকাশ করে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ট্রেন পছন্দ করি; আমার পরিবারও তাই করে। ঢাকার উত্তরায় থাকি আমি এবং যখনই আমি ঢাকার কেন্দ্রের দিকে ভ্রমণ করি, তখন ঢাকা মেট্রোরেল ব্যবহার করতে পছন্দ করি।’
তবে শহিদুর দুঃখ করে একটি বড় চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে বলেন, 'আমি কাউন্টার থেকে টিকিট কিনতে পারি না, এমনকি অনলাইনেও না। আমাকে কালোবাজারিদের উপর নির্ভর করতে হয়, যারা বেশ 'নম্র' এবং আমার বাড়িতে টিকিট পৌঁছে দেয়।’
শহিদের মতো অনেক বাংলাদেশীরও ট্রেন ভ্রমণ পছন্দ। কিন্তু, যথেষ্ট সরকারি বিনিয়োগ সত্ত্বেও দেশের রেল ব্যবস্থা এখনো যাত্রীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।
বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও চ্যালেঞ্জগুলো এখনো রয়ে গেছে। এটি ক্রমবর্ধমান চাহিদা কার্যকরভাবে পূরণ করার পদ্ধতির সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ১ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৪টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়াও ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩২টি অসম্পন্ন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের চ্যালেঞ্জ
রেলওয়ের অনেক প্রকল্প বিলম্ব এবং কার্যকর পরিকল্পনার কারণে ভুগছে। এর মধ্যে পর্যাপ্ত জনবল এবং পুরানো সরঞ্জাম অন্যতম। সমন্বিত কৌশলের অভাবে নতুন উদ্যোগের কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে।
তারা বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে ইঞ্জিন, কোচ এবং জনবলের ঘাটতিতেও ভুগছে। এর ফলে পরিষেবা সম্প্রসারণ এবং দক্ষতার সাথে নতুন লাইন পরিচালনার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে যে রাজস্ব আয় করে, তা পরিচালন ব্যয় মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। যার ফলে সৃষ্ট আর্থিক চাপ প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাদের মতে, তহবিল তছরুপ এবং অভ্যন্তরীণ অনিয়মের খবরগুলো জনসাধারণের আস্থা আরো কমিয়ে দেয় এবং অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক ইউএনবিকে বলেন, জনপ্রিয় পরিবহন মাধ্যম হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের রেলওয়ে খাত অদক্ষতা এবং সরকারের একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে সঙ্কটে ভুগছে।
তিনি এর জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সেবামুখী মানসিকতার অভাবকে দায়ী করেন। যারা পরিষেবার উন্নতির পরিবর্তে ব্যক্তিগত লাভের জন্য অবকাঠামোর দিকে মনোনিবেশ করেন। নৌপথ, সড়ক এবং বিমান পরিবহনের বিপরীতে, যেখানে বেসরকারি সংস্থাগুলো মূল ভূমিকা পালন করে। সেখানে রেলপথ সম্পূর্ণরূপে সরকার-নিয়ন্ত্রিত। যার ফলেই মূলত অব্যবস্থাপনা এবং ভর্তুকির উপর নির্ভরতা দেখা দেয়।
ড. হক বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী রেলওয়ে যাত্রীসেবায় লোকসান পুষিয়ে নিতে কন্টেইনার পরিবহনের মাধ্যমে রাজস্ব আয় করে। বাংলাদেশে জবাবদিহিতা ও পেশাদারিত্বের অভাবে এই সম্ভাবনা অব্যবহৃত রয়ে গেছে।’
তিনি বিদেশ সফরের মাধ্যমে উন্নয়ন তহবিলের অপব্যবহারের মতো নির্বোধ আচরণের জন্য পূর্ববর্তী সরকারগুলোর সমালোচনা করেন।
ড. হক রেলওয়ে সেবার কাঠামোগত সংস্কার, স্বচ্ছতা ও আংশিক বেসরকারিকরণের সুপারিশ করেন। তিনি এই খাতের সম্ভাবনা উন্মোচনের জন্য একটি পেশাদার পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেছে, গণশুনানি চালু করে ব্যর্থতার জন্য কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যেতে পারে। ‘যদি আপনারা সেবা দিতে না পারেন তাহলে সরে দাঁড়ান।’
উপদেষ্টার দৃষ্টিভঙ্গি
নতুন উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ইউএনবিকে বলেন, ‘অতীতে যা ঘটেছিল তা আমরা পরিবর্তন করতে পারি না। তবে আমরা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করছি। এখন লোকোমোটিভের ঘাটতি রয়েছে, সেগুলো সংগ্রহের কাজ চলছে। কোচের সংখ্যা বাড়ানো এবং ওয়ার্কশপ ও মেরামতের সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’
উপদেষ্টা জয়দেবপুর-ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি রুটে কমিউটার ট্রেন সার্ভিস চালুর পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন। আগামী ২৬ মার্চ নরসিংদী-ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রুটে সার্ভিস চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, অধিক চাহিদা মেটাতে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে অতিরিক্ত একজোড়া ট্রেন চালু করা হবে।
উপদেষ্টা বলেন, ‘আগে রেললাইন ও স্টেশন সম্প্রসারণ করা হলেও ইঞ্জিন ও কোচের সংখ্যা বাড়ানো হয়নি। আমরা আমাদের সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করার চেষ্টা করছি।’
ঢাকা মেট্রোরেল : একটি গেম-চেঞ্জার
সদ্য চালু হওয়া ঢাকা মেট্রোরেল নগর যাতায়াতের রূপান্তর ঘটাচ্ছে। এমআরটি লাইন-৬ বর্তমানে চালু রয়েছে এবং পাঁচটি লাইনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। মেট্রো ব্যবস্থার লক্ষ্য ঢাকার সীমাহীন যানজট কমানো এবং বায়ু দূষণ হ্রাস করা।
প্রতি ঘণ্টা ৬০ হাজারের বেশি যাত্রীকে সেবা সরবরাহ করার জন্য নকশা করা হয়েছে। মেট্রোরেল যাত্রীদের গতি, সুরক্ষা এবং সুবিধা সরবরাহ করে দ্রুত শহুরে যাতায়াতের জন্য একটি পছন্দসই বাহন হয়ে উঠছে।
যাত্রীদের অভিজ্ঞতা
সারা বাংলাদেশে অগণিত যাত্রীদের জন্য ট্রেন একটি অপরিহার্য পরিবহন মাধ্যম।
ঢাকার মিরপুরে বসবাসরত সাংবাদিক এম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'ট্রেনে চড়ার মাধ্যমে যানজটে আটকে না থেকে পেশাগত কাজ ও পরিবারে বেশি সময় ব্যয় করতে পারছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কায়সার আহমেদ বলেন, 'ট্রেন আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশদ্বার। এটি সাশ্রয়ী মূল্যের এবং নির্ভরযোগ্য, যা আমার প্রতিদিনের যাতায়াতকে সহজ করে তোলে।’
জাহাঙ্গীর ও কায়সার উভয়েই বলেন, রেল পরিবহন শুধু সাশ্রয়ীই নয়, পরিবেশবান্ধবও বটে। সমপরিমাণ যাত্রী বা মালবাহী পরিবহনে সড়ক যানবাহনের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম জ্বালানি খরচ করে।
উন্নয়নের সুযোগ
উৎসাহমূলক হিসেবে সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জন্য ১৮ হাজার ৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
অবকাঠামো আধুনিকীকরণ, আন্তঃনগর পরিষেবা উন্নত করা এবং কন্টেইনার পরিবহন বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগটি দেয়া হয়।
ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু দিয়ে নতুন রুট উদ্বোধনের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যোগাযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে।
২০ বছর মেয়াদি রেলওয়ের বিশদ পরিকল্পনার ভিত্তিতে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩৫টি প্রকল্পের রূপরেখা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, ৪৪টি জেলাকে সংযুক্ত করা এবং গেজ ব্যবস্থাকে মানসম্মত করে পরিচালন সক্ষমতাকে সুবিন্যস্ত করা। সড়ক ও অভ্যন্তরীণ নৌ ব্যবস্থার সাথে একীকরণকেও অগ্রাধিকার দেয়া হয়। যা একটি সমন্বিত জাতীয় পরিবহন কাঠামো তৈরি করে।
বিশ্বের শীর্ষদের কাছ থেকে শিক্ষা
রেলওয়ে খাতে বিশ্বের সেরা নেতৃত্বের কাছ থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।
জাপানের শিনকানসেন নিরাপত্তা ও দক্ষতার ক্ষেত্রে স্বর্ণমান নির্ধারণ করে। অন্যদিকে ভারতের ডেডিকেটেড ফ্রেইট করিডরগুলো বিশেষায়িত পণ্য পরিবহণের সুবিধাগুলোকে তুলে ধরে।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বাণিজ্যের জন্য সমন্বিত রেল নেটওয়ার্কের সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এছাড়া সড়কের পরিবর্তে রেলে মাল পরিবহনে ইউরোপে রেল পরিবহনের সাফল্য এবং পরিবেশগত ও যৌক্তিক সুবিধাগুলোও উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ রেলওয়েকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, গেজ পদ্ধতির আধুনিকায়ন এবং বহুমাত্রিক পরিবহন সমন্বয় করার দিকে মনোনিবেশ করার মতো কৌশলগত পদ্ধতি প্রয়োজন।
বাংলাদেশ রেলওয়েকে বিশ্বমানের পরিবহন সেবায় পরিণত করতে পরিচালন দক্ষতা জোরদার, কর্মীদের কর্মসক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অধিকতর স্বচ্ছতা বাড়ানো অপরিহার্য।
ক্রমবর্ধমান জনসাধারণের চাহিদা এবং সরকারের অতিরিক্ত তদারকিতে রেলওয়ে দেশের উন্নয়ন যাত্রায় রূপান্তরকারী ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত। এর আধুনিকায়ন ও দক্ষতা নিশ্চিত করা গেলে কেবল গতিশীলতাই বাড়বে না, জাতীয় অগ্রগতির ভিত্তি হিসেবে এর অবস্থানও সুরক্ষিত হবে।
সূত্র : ইউএনবি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা