অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩:৪১, আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩:৪২
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা যখন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তখন দেশের অর্থনীতি অনেকটাই বিপর্যস্ত। ব্যয় মেটাতে সরকার ঋণ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছিল।
দ্রব্যমূল্য তখন ঊর্ধ্বমুখী। বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় মানুষের নতুন চাকরির সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে। এরসাথে ডলার সঙ্কটে টান পড়েছে রিজার্ভে। সরকার যে বিদেশ থেকে প্রয়োজন মতো জিনিস কিনবে, সেই সক্ষমতা ন্যূনতম পর্যায়ে চলে এসেছে। আবার বিদেশী ঋণ শোধ করতেও হিমশিম অবস্থা।
বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা বড় অংকের ঋণ নিয়ে শোধ না করায় খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়। বেশ কয়েকটি ব্যাংক টাকার অভাবে গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে পারছিল না।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক বছর ধরেই নানা সঙ্কটে। কখনো রিজার্ভে ঘাটতি, কখনো জিনিসপত্রের দাম, কখনো কর্মসংস্থান-অর্থনীতির সঙ্কট হাজির হয়েছে নানা চেহারায়।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ বলছে, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাটা আগামী বছর অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য আরো কঠিন হবে।
বিশেষ করে তারল্য সঙ্কট, মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার?
টাকা ছাপিয়েও সবল হচ্ছে না দুর্বল ব্যাংক
বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে টাকা ছাপানোর যন্ত্র আছে। কিন্তু সরকার চাইলেই ইচ্ছেমতো টাকা ছাপায় না। কারণ তাহলে বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়বে। এতে টাকার মূল্য কমে যাবে, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে। বেশি দামে কিনতে হবে জিনিসপত্র।
কিন্তু এরপরও নিরেট অর্থনৈতিক নীতির বাইরে গিয়েও সরকার টাকা ছাপিয়ে থাকে।
এর আগে, আওয়ামী লীগ সরকার টাকা ছাপিয়ে ব্যয় নির্বাহের চেষ্টা করেছে। শেষ সময়ে এসেও তারা টাকা ছাপিয়ে ব্যয় নির্বাহের চেষ্টা করেছে।
অর্থ উপদেষ্টা সম্প্রতি জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ছাপিয়েছে।
কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারও সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বিভিন্ন ব্যাংককে সহায়তা দিয়েছে। যার মূল কারণ ওইসব ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট বা টাকার সঙ্কট।
মূলত গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে না পারার পরিস্থিতিতে পড়া ছয়টি ব্যাংককে বাঁচাতে টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে লেনদেন চালিয়ে নিতে পারলেও অধিকাংশ ব্যাংকই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে পারেনি।
ফলে নতুন বছরেও এ সঙ্কট চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে বলেই মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে কিছু কিছু ব্যাংক আছে, যার জন্য এটা আসলে অতখানি তারল্য সঙ্কটের ব্যাপার না। এটা হলো পুঁজির ঘাটতি। দেখা যাচ্ছে তার পুঁজির ঘাটতি অনাদায়ী ঋণের কারণে এমন জায়গায় গিয়েছে যে সাময়িকভাবে তারল্য দিয়ে এগুলোর সমাধান করা যাবে বলে আমার মনে হয় না।’
তাহলে করণীয় কী? এমন প্রশ্নে ‘পুঁজি পুনর্গঠনে’ সহায়তার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এসব ব্যাংকের জন্য আরো অনেক বেশি পুঁজি পুনর্গঠনের প্রয়োজন পড়বে। তাদের যদি পর্যাপ্ত পুঁজির ব্যবস্থা না করা যায় তাহলে কিছুই হবে না। সেই পুঁজিটা এভাবে হতে পারে যে, তাদের যেসব ঋণ আছে সেটা যদি কেউ কিনে নেয়, অথবা তাদের যদি বন্ড ইস্যু করার সুযোগ দেয় অথবা যদি বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে যদি ব্যাংকগুলোকে আরেকটু শক্তিশালী করা যায় তাহলে সেটা কাজে লাগবে।’
কিন্তু প্রশ্ন হলো এর আগেই সরকার যে তারল্য সহায়তা দিয়েছে সেটা কেন ব্যাংকগুলো কাজে লাগাতে পারলো না? এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বরং আরো সহায়তা চাওয়া হচ্ছে ব্যাংকগুলো থেকে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান ড. এইচ মনসুর বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে তারা জোর দিয়েছিলেন দুর্বল ব্যাংকগুলো যেন বেঁচে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘এখানে ব্যাংকগুলো থেকে টাকা দেশের বাইরে চলে গেছে ঋণের মাধ্যমে। ‘সরকার স্পন্সরড’ ব্যাংক ডাকাতির মাধ্যমে বেশ কিছু পরিবারকে ঋণগুলো দিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে কিছু কিছু ব্যাংকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এক শ’ টাকার মধ্যে নব্বই টাকাই নাই। সেক্ষেত্রে এসব ব্যাংককে কিন্তু বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হবে। সেজন্যই এ সহায়তা দেয়া জরুরি ছিল। যেন তারা একটু সময় পায়।’
কিন্তু এরপরও কেন সঙ্কট মেটেনি? এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক কিংবা ইউসিবিএল-এর মতো কিছু ব্যাংক তারল্য সঙ্কট কাটিয়ে উঠছে অর্থাৎ তারল্য সহায়তা কাজে লাগছে।’
তিনি বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকের কথা যদি ধরেন, গত চার মাসে তাদের বিভিন্ন গ্রাহক টাকা তুলে নেয়ার পরও ব্যাংকটি সাত হাজার কোটি টাকা টাকা নেট ডিপোজিট মোবিলাইজ করতে পেরেছে। এর বাইরেও কিছু কিছু ব্যাংক এ সমস্যাটা ওভারকাম করার চেষ্টা করছে। এরপরও যদি তারা বাঁচতে না পারে তাহলে সরকার তাদের অধিগ্রহণ করবে অথবা ভিন্ন কোনো ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু গ্রাহকদের ভয় পাবার কিছু নেই।’
টাকা ছাপানোয় মূল্যস্ফীতি কি বাড়বে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পৌনে তিন লাখ কোটি টাকারও বেশি। ব্যাংকগুলো যে ঋণ বিতরণ করেছে তার ১৭ শতাংশই খেলাপি হয়েছে। অর্থাৎ এসব ঋণ ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না।
কিন্তু কোনো কোনো ব্যাংকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রভাবশালীরা এসব ব্যাংক থেকে মোট পুঁজির আশি থেকে নব্বই শতাংশ টাকাই ঋণ হিসেবে বের করে নিয়েছেন। ফলে ব্যাংকগুলোতে আমানত রাখা টাকা গ্রাহকরা ফেরত পাচ্ছেন না।
সরকার টাকা ছাপিয়ে আপাতত ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইলেও এটা আবার নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে আগে থেকেই বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে।
আইএমএফ গত ডিসেম্বরে এক হিসাবে জানিয়েছে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি এখন ১১ শতাংশের কাছাকাছি।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আশাবাদী মূল্যস্ফীতি বাড়বে না বরং কমে আসবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল্যস্ফীতি কমবে। আশা করি, এটা আগামী জুন মাসের মধ্যে সাত শতাংশে নেমে আসবে। আর ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে এটা পাঁচ শতাংশে নেমে আসবে।’
কিন্তু অনেকেই যখন মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তখন সরকারের মূল্যস্ফীতি কমানোর আশাবাদের পেছনে কারণ কী? এটা কীভাবে করা হবে? তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য দু’টি বিষয়ে কাজ করা জরুরি। একটা হচ্ছে, ডিমান্ড বা চাহিদা। আরেকটা হচ্ছে সাপ্লাই বা যোগান। ডিমান্ড সাইডে আমরা যেটা করছি সেটা হচ্ছে, সরকারের কিছু ব্যয় কাটছাঁট করে সরকারের যে ঋণ নেয়ার প্রবণতা সেটা কমিয়ে আনছি অর্থাৎ অর্থনীতিতে চাহিদাকে সংকুচিত করছি। আবার মূদ্রানীতির ক্ষেত্রেও আমরা সুদের হার বাড়িয়ে ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রবাহ ধীর করে দিয়ে চাহিদা কমিয়ে আনছি। এতে যেটা হবে যে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে যে ঘাটতি সেটা কমে আসবে, মূল্যস্ফীতিও কমে আসবে।’
চাকরি হারাচ্ছেন শ্রমিক, কর্মসংস্থানের কী হবে?
দেখা যাচ্ছে, সরকার তার খরচ কমিয়ে এবং ব্যক্তিখাতে ঋণ সংকুচিত করে মূল্যস্ফীতির চাপ সামলানোর নীতি নিয়েছে।
কিন্তু এর ফলে বড় বড় প্রকল্প বন্ধ হয়ে কিংবা কাটছাঁট হয়ে এবং ব্যক্তি উদ্যোগে বিনিয়োগ কমে গিয়ে কাজ হারাচ্ছেন অনেকেই।
এরসাথে যুক্ত হয়েছে পালিয়ে যাওয়া সাবেক সরকারি দলের নেতাদের মালিকানায় থাকা কারখানা কিংবা শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্কট।
বন্ধ হওয়া এসব কারখানার হাজার হাজার শ্রমিকের কী হবে সেটা অনিশ্চিত। ফলে অর্থনীতির তৃতীয় যে চ্যালেঞ্জটি নতুন বছরেও বড় হয়ে উঠছে সেটা হচ্ছে কর্মসংস্থান।
বড় বড় প্রকল্প বন্ধ হয়ে কিংবা কাটছাঁট হয়ে এবং ব্যক্তি উদ্যোগে বিনিয়োগ কমে গিয়ে কাজ হারাচ্ছেন অনেকেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি মনে করেন যেসব ‘তোষণ বিনিয়োগ’ হুমকির মুখে পড়েছে, সরকারকেই সেগুলো চালিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে কর্মসংস্থানের চিত্র আরো খারাপ হবে।
শরমিন্দ নীলোর্মি বলেন, ‘সরকার ঘনিষ্ট সবাই তো আর টাকা বিদেশে নেয়নি। অনেকেই দেশেও বিনিয়োগ করেছেন। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে এসব বিনিয়োগের ব্যাপারে জনমনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কিন্তু যেহেতু বিনিয়োগ হয়েছে এগুলো সরকারি ব্যবস্থানায় অন্তত বেশ কিছু দিন চালিয়ে নেয়া প্রয়োজন বিশেষত যেগুলো ভালো প্রতিষ্ঠান। যেন কর্মসংস্থানের জন্য ভুল বার্তা না যায়। অর্থাৎ আমার নতুন কর্মসংস্থান তো তৈরি করতে হবেই, পুরনো কর্মসংস্থানও যেন ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে সেটা মাথায় রাখতে হবে। এর পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগও দরকার হবে। কারণ বিনিয়োগ হলে কাজ সৃষ্টি হয়। মানুষ কাজ পায়।’
বিনিয়োগ কি বাড়বে?
বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ নিম্নমুখী। বিদেশী বিনিয়োগ এলে দেশে ডলার পাওয়া যায়, কর্মসংস্থান তৈরি হয়।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় ৮.৮ শতাংশ কমে গেছে।
বিনিয়োগ যে বাড়ছে না কিংবা স্থবির হয়ে আছে সেটাকে খারাপ লক্ষণ হিসেবেই বিবেচনা করেন অর্থনীতিবিদরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জোর দিচ্ছেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নের ওপর। তার মতে, অর্থনীতির সূচকগুলো ভালো হতে থাকলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও আকৃষ্ট হবে।
তিনি বলেন, ‘আমার এখানে যদি মূল্যস্ফীতি সবসময়ই উচ্চপর্যায়ে থাকে। টাকার যদি দ্রুত অবমূল্যায়ন হতেই থাকে, রিজার্ভ যদি নামতে থাকে তাহলে তো কারো এ দেশে আস্থা থাকবে না। তখন কি কেউ এখানে বিনিয়োগ করতে আসবে? আসবে না। কাজেই আমাদেরকে দ্রুততার সাথে চেষ্টা করতে হবে সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটা ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা।’
তিনি আরো বলেন, ‘রিজার্ভের পতন ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। রিজার্ভ বাড়ছে। রিজার্ভ থেকে আমাদের আর ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে না। আমাদের ডলারের বিনিময় হার মোটামুটি স্থিতিশীল আছে। কাজেই আমি মনে করি, আমাদের এক্সটার্নাল সেক্টর যেটা আমাদের অর্থনীতিতে সঙ্কটের মূল উৎস সেখানে কিন্তু আমরা অনেকখানি অর্জন করে ফেলেছি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নানা পদক্ষেপের কথা বলছেন। তবে নিরেট এসব অর্থনৈতিক পদক্ষেপ দিয়েই যে অর্থনীতির চাকা ভালোভাবে সামনের দিকে ঘুরতে থাকবে, তেমনটা নাও হতে পারে। বিশেষ করে জনমনে অসন্তোষ কিংবা দেশের রাজনীতিতে অনিশ্চিয়তা থাকলে অর্থনীতির পথও কঠিন হয়ে যায়, বাংলাদেশের সঙ্কটটা সেখানেই।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা